সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের অনন্য অভিজ্ঞতা
চোখ মেললেই বিশাল আকাশ—তখন ভয়ও যেন হারিয়ে যায় সেই আকাশের বিশালতার কাছে। এমন একসঙ্গে আকাশ দেখার এক অনন্য উপায় সেন্ট মার্টিন যাত্রায়। মাঝেমধ্যেই দেখা মেলে অ্যালবাট্রসের, নির্ভয়ে সারেং-এর মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে তারা। কখনও একা, কখনও বা একঝাঁক। আকাশ রেখে পাখির দিকে মন দিলে, সময় কখন কেটে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। পাখিগুলো কিছুক্ষণ উড়ে হঠাৎ পানিতে ঝাপ দেয়। আবার ভেসে উঠে উড়াল দেয়। এ যেন প্রকৃতির এক আশ্চর্য খেলা—শিকার আর শিকারীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশগ্রহণ।
বিশাল সমুদ্রে ডানা মেলে গাঙচিলের যে স্বাধীনতা, তাতে ভেসে থাকার ইচ্ছা কার না জাগে! মনে হয়েছিল, এই ছোট্ট জাহাজ থেকে নেমে দু'পাশে উড়ে চলা শুভ্র গাঙচিলের সঙ্গে মিশে যাই নারকেল জিঞ্জিরার কোলে। সবুজ পাহাড় আর বিশাল জলরাশির ভ্রমণ সৌন্দর্যও যেন মোহিত করতে পারেনি, কারণ একটাই—সেন্ট মার্টিন দেখার অপেক্ষা। তবে যা ভেবেছিলাম, তা হয়নি। অভিজ্ঞতা ছিল ভিন্ন।
সেন্ট মার্টিন তথা নারকেল জিঞ্জিরার নীল জলরাশিতে ভেসে বেড়ানোর আনন্দ আর স্বাতন্ত্র্য বাংলাদেশের ভ্রমণপিপাসুদের প্রথম পছন্দ। তবে এই স্বর্গীয় দ্বীপে পা রাখতে যত ঝামেলা পোহাতে হয়, তা এক ভিন্নধর্মী ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
আমাদের এবারের দলে ছিল ঊনচল্লিশ জন, সবাই সহকর্মী। এ যাত্রায় দু'জন শিশুও ছিল তাদের মায়ের সঙ্গে। আনন্দ ভ্রমণের এ অভিজ্ঞতা ছিল ভালো-মন্দের মিশ্রণ।
জাহাজ বিড়ম্বনা
রিজার্ভ করা গাড়িতে সকাল সাড়ে সাতটায় কক্সবাজার পৌঁছালাম। জাহাজ ছাড়ার সময়ও সাড়ে সাতটা। দু'জন দৌড়ে গিয়ে শুনলাম, জাহাজ ছাড়বে নয়টায়। তবে জাহাজে ওঠার ভিড় দেখে মনে হলো ঈদ উপলক্ষে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল নেমেছে। ভিড় ঠেলে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম নুনিয়ারছড়ার বিআইডব্লিউ ঘাটে। সাড়ে আটটায় ফিরে শুনলাম, কেয়ারি সিনবাদ জাহাজ ছেড়ে গেছে। মাথায় বাজ পড়ার মতো পরিস্থিতি! যাত্রীরা চেঁচামেচি করতে থাকল। নীল জলরাশির মোহনীয় সৌন্দর্য উপভোগ তো দূরের কথা, কী করব তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম।
অবশেষে কোস্ট গার্ডের মাধ্যমে জানা গেল, অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে কেয়ারি সিনবাদ টিকিট কাটা যাত্রীদের রেখেই চলে গেছে। তাদের ফোনে যোগাযোগ করে ফেরত আসতে বলা হলো। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের জন্য জরিমানা দেওয়ার পর অবশিষ্ট যাত্রীদের জাহাজে উঠতে দেওয়া হলো। জানা গেল, এটা না-কি তাদের নিয়মিত ঘটনা!
যুদ্ধ জয়ের আনন্দ উপভোগ করার আগেই জাহাজে ওঠার যন্ত্রণায় সবাই যেন ক্লান্ত। পাঁচটি জাহাজের সরু সর্পিল গলিপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যেন এক মহাযন্ত্রণা। জাহাজে দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণের ক্লান্তি আরও বেশি বিরক্তিকর হয়ে ওঠে।
মিয়ানমার ইস্যুতে নতুন এই রুট শুরু হয়েছে। আগে টেকনাফ থেকে মাত্র আড়াই–তিন ঘণ্টায় সেন্ট মার্টিন পৌঁছানো যেত, এখন কক্সবাজার থেকে ছেড়ে যায় জাহাজ। সেখানে পৌঁছাতে কমপক্ষে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। জাহাজে ওঠানামার যন্ত্রণা ভাবলেই ক্লান্তি আরও বাড়ে।
জেটিঘাটের ভিড়
আগে টেকনাফ থেকে সকালেই রওনা দিয়ে দুপুরে সেন্ট মার্টিন পৌঁছানো যেত, বিকেলে ফেরার সুযোগও ছিল। এখন কক্সবাজার থেকে যেই জাহাজ যায়, তা আবার ফিরে আসার পথে যাত্রী নিয়ে চলে। একসাথে হাজার হাজার মানুষের ভিড় দেখে মনে হয়, হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার দৃশ্য। এই দৃশ্য শুধু কষ্টকরই নয়, চোখের জন্যও এক অশান্তির মতো।
যান্ত্রিক অত্যাচার
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নামার পর মটরসাইকেলই হয়ে দাঁড়ায় এক আলাদা যন্ত্রণা। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন স্বর্গীয় পরিবেশ উপভোগ করার আশা নিয়ে সেখানে পৌঁছান, তখন এসব যানবাহনের কারণে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়। সকাল বা বিকাল, মোটরবাইক ছুটে চলে। সৈকতে বসে সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করার সময়ও বিকট শব্দে কেঁপে উঠতে হয়। সমুদ্র গোসলে নামা, সৈকতে বাচ্চাদের স্যান্ড ক্যাসেল বানানো, আর পিছন থেকে হর্নের শব্দ – এসবের মধ্যে সমুদ্রের নিস্তব্ধতা আর শান্তি হারিয়ে যায়।
অপরিকল্পিত রিসোর্ট নির্মাণ
সেন্ট মার্টিনের রিসোর্টগুলোর অপরিকল্পিত নির্মাণ দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশের ক্ষতি করছে। সুন্দর নারকেল গাছের সারি বিলীন হয়ে যাচ্ছে, আর রিসোর্ট মালিকরা সি ভিউয়ের জন্য গাছ কেটে ফেলে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করছেন। অথচ, পর্যটকরা এই দ্বীপের প্রকৃতি এবং পরিবেশের সৌন্দর্যেই আসেন। মানুষের অতি আবেগ আর তাড়াহুড়োর কারণে সেন্ট মার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ক্রমেই হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
সেন্ট মার্টিনের এক সময়কার বিশাল সাইজের ডাব, যা এই দ্বীপের একটি পরিচিত চিহ্ন ছিল, এখন আর তেমন দেখা যায় না। ছোট ছোট ডাব বিচের দোকানগুলোতে ঝুলছে, গাছে কমই দেখা যায়। দামও অনেক বেড়ে গেছে—দুইশো থেকে আড়াইশো টাকা। স্থানীয় দোকানদার জমির উদ্দিন জানালেন, রিসোর্ট তৈরির ফলে গাছ কাটা হচ্ছে। মাঝে মাঝে টেকনাফ থেকেও ডাব আনা হয়।
তবে এসব কষ্ট ও অসুবিধার পরও, যখন পর্যটকরা সেন্ট মার্টিনের নির্জন সমুদ্র সৈকতে পৌঁছান, তখন সব কষ্টের কথা ভুলে যান। সমুদ্রের নীল জলরাশি, সৈকতের সাদা বালি আর দক্ষিণ পাড়ার নারকেল গাছের মৃদু ছায়া যেন এক রূপকথার রাজ্য। সাগরের তাজা মাছ আর সুনসান নীরবতা মনকে প্রশান্তি এনে দেয়। রাতে আকাশের তারাগুলো সমুদ্রের পানিতে প্রতিফলিত হয়ে এক মায়াবী আলোর আবেশ সৃষ্টি করে।
ছবি: লেখক