‘অনাচারের অর্থনীতি’ সৃষ্টি করেন আমলা, উর্দিধারী কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী চক্র: দেবপ্রিয়
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে প্রায়শই স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি দরে প্রকল্পের কাজ দেওয়া হতো। পরে আনসলিসিটেড প্রক্রিয়ায় প্রকল্প দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই দরের চেয়ে সামান্য কমানো হতো।
এর মধ্য দিয়ে ওপেন টেন্ডার কিংবা আনসলিসিটেড—যে প্রক্রিয়াতেই প্রকল্পের কাজ দেওয়া হোক না কেন, সেখানে অনেক বেশি অনিয়ম ও দুর্নীতির সুযোগ রাখা হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় প্রকল্প থেকে মোটা অংকের অর্থ দুর্নীতি করার এসব অভিনব পদ্ধতি জানতে পেরেছে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)-এর সদস্যদের জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির মতবিনিময় সভায় হাসিনা সরকারের সময় প্রকল্প থেকে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির তথ্য তুলে ধরেন কমিটির সদস্যরা।
প্রকল্প বারবার সংশোধন করার সময় প্রকল্পে নতুন নতুন অঙ্গ যোগ করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ব্যয় বাড়িয়ে দুর্নীতির সুযোগ যেমন করা হয়েছে, তেমনি প্রকল্পের সরবরাহকারীর মুখ দেখে ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় কেনার তথ্যও পেয়েছে জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি।
মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতি
কমিটির সদস্য ও বুয়েটের অধ্যাপক এম তামিম তামিম বলেন, হাসিনা সরকার উদ্দেশ্যমূলকভাবে বড় অর্থায়নের সুযোগ কাজে লাগাতে বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
'বড় প্রকল্পে বেশি দুর্নীতির সুযোগ থাকার কারণে শুধু বড় বড় প্রকল্পই নেওয়া হয়েছে। ছোট প্রকল্প খুব বেশি নেওয়া হয়নি। দুর্নীতির পুরস্কার হিসেবে বিভিন্নজনকে বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, এমনকি একুশে পদকও দেওয়া হয়েছে,' তিনি বলেন।
জ্বালানি খাতের প্রকল্পের মূল্যায়ন করা অধ্যাপক তামিম বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতের দুর্নীতিগুলো শেখ হাসিনার সম্মতিতে হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, মূল সিদ্ধান্তগুলো কেন্দ্রীভূত ছিল; নির্বাচিত কোম্পানিগুলোকে যোগ্যতার পরিবর্তে নির্দেশের ভিত্তিতে চুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
কমিটির সদস্য এবং সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশিষ্ট ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রকল্পের প্রস্তাবগুলো প্রায়ই পর্যাপ্ত তদারকি ছাড়াই অনুমোদন করা হয়, যার ফলে অপচয় হয়।
হাসিনার মেয়াদে মেগা প্রকল্প ও অর্থপাচার বিষয় বিশ্লেষণের দায়িত্বে থাকা মোস্তাফিজুর বলেন, 'সরকারের রাজস্ব ঘাটতির কারণে এসব প্রকল্পের অর্থায়ন অনেক বেশি নির্ভর করত উচ্চ সুদে ঋণের ওপর, যা বরং ঋণ পরিষেবায় ব্যবহার করা যেত।'
২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে গত জুন পর্যন্ত সংশোধিত বাজেটে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ১৮.৮৩ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ী তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ঢাকায় মেট্রোরেল চালু, পদ্মা সেতু, পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল—এই সাতটি মেগা প্রকল্পে ব্যয়ের পরিমাণ হবে প্রায় ২.৩০ লাখ কোটি টাকা।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রকল্প নেওয়ার পর তা বারবার সংশোধন করে অনেক বেশি ব্যয় বাড়িয়ে দুর্নীতির সুযোগও বাড়ানো হতো।
'প্রকল্পে নতুন নতুন এলিমেন্ট যুক্ত করা হতো। এর ফলে কিছু মানুষ আগে থেকেই জানত যে, সরকার জমি অধিগ্রহণ করবে। তখন জমির দাম ১০ গুণ বাড়ানো হতো। সরকার তারপর তিনগুণ দামে তা অধিগ্রহণ করত,' তিনি বলেন।
কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'দুর্নীতির জন্য এমন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হতো, যার সঙ্গে মানুষের চাহিদার কোনো সম্পর্ক নেই। সরবরাহকারীদের কারণে ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় কেনা হতো।'
তিনি আরও বলেন, বড় চুরি হয়েছে ব্যাংক খাত, জ্বালানি খাত, আইসিটি খাতে। ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ খাতে বড় বিনিয়োগে অতিমূল্যায়িত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
দেবপ্রিয় বলেন, প্রকল্প গ্রহণে স্থানীয় মানুষের মতামত নেওয়া হয়নি। হাইটেক পার্কসহ বড় প্রকল্পগুলো শ্বেতহস্তীতে পরিণত হয়েছে।
আমলা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের চক্র
দেবপ্রিয় বলেন, সামরিক-বেসামরিক আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মিলে অনাচারী অর্থনীতি ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছিল। আর অনাচারী অর্থনীতি রক্ষার স্বার্থে স্বৈরাচারী রাজনীতি দরকার ছিল। তারাই একক কেন্দ্রীয় স্বৈরাচারী রাজনীতিকে উসকে দিয়েছে।
তিনি বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) 'অবহেলায় রয়েছে' এবং এর পুনর্গঠনের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান উল্লেখ করেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠার পর তারা উন্নয়নের বয়ান তৈরি করেছে।
তিনি বলেন, "তখন থেকেই 'চামচা পুঁজিবাদ' তৈরি হয়। সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা যত দূর্বল হতে থাকে, ততই প্রকল্প নির্ভর দুর্নীতি বাড়তে থাকে।"
'আমরা প্রকল্পে দুর্নীতির নানা রূপ পেয়েছি। রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ীরা মিলে একটি অ্যালায়েন্স [জোট] করে উন্নয়ন ধারণাকে স্থায়ী রূপ দিয়েছিল। তারা মেগা প্রকল্প নিয়েছে আর দুর্নীতি করেছে। সরকার বিভিন্ন সময় প্রতিষ্ঠান সংস্কারের উদ্যোগ নিলেও এই নেক্সাস বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তা সম্ভব হয়নি,' তিনি বলেন।
কমিটির আরেক সদস্য ও ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের সাবেক ডিন অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, প্রকল্প থেকে দুর্নীতি করার ক্ষেত্রে অফিসার ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে একটি নেক্সাস [চক্র] তৈরি হয়েছিল।
তিনি উল্লেখ করেন, ২০১৮ সালের পর এই নেক্সাস আরও বেড়েছে। যার ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব হয়েছে এবং সময়সীমা এবং বাজেটের বারবার বাড়ানো হয়েছে, যা উল্লেখযোগ্য অর্থ আত্মসাৎ করতে সক্ষম হয়েছে।
কমিটি সরকারি ব্যয় নির্ণয় করেছে কিন্তু এখনও দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারেনি বলে জানান তিনি।
শ্বেতপত্র কমিটির সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, যদিও প্রতিটি প্রকল্প যাচাই করা সম্ভব হয়নি, কিছু প্রকল্পে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে যে, ৬০%-৭০% পর্যন্ত দুর্নীতি হয়েছে। মেগা প্রকল্পগুলোতে ২০% এর মতো দুর্নীতি হলেও টাকার অংকে এর পরিমাণ অনেক বেশি।
অর্থ পাচার ও ফেরত আনা
শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে, তার একটি অনুমানভিত্তিক হিসাব তুলে ধরবে শ্বেতপত্র কমিটি।
এ বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স (জিএফআই) ২০০৯ থেকে ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের যে ফলাফল দিয়েছে, তার ভিত্তিতে অনুমান করে একটা হিসাব করছি।
'এর মধ্যে অর্থনীতির আকারও অনেক বেড়েছে। ব্যালেন্স অব পেমেন্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে অর্থপাচারের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে।'
মতবিনিময় সভা শেষে টিবিএসের প্রশ্নে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গভর্নর শুধু ব্যাংক খাত থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার কথা বলেছেন।
'শ্বেতপত্র কমিটি সামগ্রিকভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচারের হিসাব তুলে ধরবে, যার পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি হবে,' তিনি বলেন।
জিএফআই-এর তথ্য অনুযায়ী, শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে আরও প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। এর আগের বছর এর পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা।
২০১৫ সাল থেকে সরকার জিএফআইকে তথ্য দেওয়া বন্ধ করার কারণে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের বিষয়টি প্রতিবেদনে প্রকাশ করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাটি।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সরকার টাস্কফোর্স করেছে এবং আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক এ ব্যাপারে সরকারকে সহায়তা করবে বলে জানান মোস্তাফিজুর রহমান।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে অন্যায়গুলো হয়েছে, তার দায় এখন জনগণের ওপর পড়বে। সরকারি ব্যয়ের জন্য আমরা পর্যাপ্ত রাজস্ব সংগ্রহ করতে পারিনি। আবার যেটুকু সংগ্রহ হয়েছে তাও আবার বিদেশের পাচার হয়ে গেছে।
'অনাচারি অর্থায়নের ঘাটতি পূরণে এবং উন্নয়নের বয়ানকে রক্ষা করার জন্য স্বৈরাচারি রাজনীতির প্রয়োজন ছিল। এক্ষেত্রে একটি চক্রাকার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছিল। বর্তমানের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে চক্রাকার সম্পর্ক ভাঙার সুযোগ তৈরি হয়েছে,' তিনি যোগ করেন।
দেবপ্রিয় আরও বলেন, অর্থনৈতিক স্বস্তির উপর আগামী দিনের রাজনীতি ও সংস্কার উদ্যোগ নির্ভর করবে। 'যদিও চলমান বিচারে রাজনীতিই সবকিছুর নিয়ামক, কিন্তু অর্থনীতি ঠিক না থাকলে রাজনীতি সেই নিয়ামক ভূমিকার সুযোগ নাও পেতে পারে।'
কমিটি
অর্থনৈতিক অনাচার মেরামত করতে কোনো সংস্কার কর্মসূচি দেবে না শ্বেতপত্র কমিটি। তবে মধ্যমেয়াদী পরিকল্পনা প্রস্তাব দেওয়া হবে।
স্বল্পমেয়াদে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে চলতি অর্থবছরের শেষ ৬ মাস এবং আগামী অর্থবছরের বাজেটে কোন ধরনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, সে সম্পর্কেও পরামর্শ থাকবে।
কমিটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার স্থিতিশীল, ব্যাংকে তারল্য বজায় রাখা, সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে পরামর্শ দেবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০২৬ সালে এলডিসি গ্রাজুয়েশন হবে কি-না, সে বিষয়ে পেশাদারী সিদ্ধান্ত দেবে কমিটি। 'এসডিজি বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। এটি ত্বরান্বিত করতে সুপারিশ করা হবে।'