ক্যামেরায় বন্দী খুলনা শহরের দুঃখ জলাবদ্ধতা!
দেশের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প নগরী খুলনাতে অন্তহীন সমস্যায় পরিণত হয়েছে জলাবদ্ধতা। সঠিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নগরবাসীর উদাসীনতার কারণে বর্ষা মৌসুম এলেই জলাবদ্ধতার ভোগান্তি বেড়ে যায় বহুগুণে। শহরের ৩১টি ওয়ার্ডে ৩১ জন প্রশিক্ষিত তরুণের ক্যামেরায় উঠে এসেছে সেই ভোগান্তির চিত্র।
আজ সোমবার (১১ নভেম্বর) সকাল ১০টায় খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে জলাবদ্ধতার ফলে নগরবাসীর ভোগান্তির আলোকচিত্র। আগামী বুধবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এসব আলোকচিত্র প্রদর্শিত হবে। এশিয়া রেজিলিয়েন্ট সিটিস প্রকল্পের আওতায় খুলনা শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনে সামাজিক গবেষণা পদ্ধতি "ফটোভয়েস"-এর অংশ হিসেবে এই আয়োজন করা হয়েছে।
প্রদর্শনীতে শহরের ৩১টি ওয়ার্ডে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ আলাদা আলাদাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ১নং ওয়ার্ডে ফটোগ্রাফার মো. রিয়াদ খানের ক্যামেরায় উঠে এসেছে, পুকুর দূষণের ফলে সুপেয় পানির অভাব, সামান্য বৃষ্টিতে হাটু পানির দুর্ভোগ, নগরবাসীর উদাসীনতায় যেখানে সেখানে গৃহস্থলী বর্জ্য ফেলা ও টয়লেটের বর্জ্য বৃষ্টি পানির সাথে মিশে যাওয়া মত ঘটনা।
একইভাবে ২ নং ওয়ার্ডে ফটোগ্রাফার শেখ নাবিয়্যীন আহমেদ নিলয়ের ক্যামেরায় উঠে এসেছে – বৃষ্টিতে বাড়ির মধ্যে পানি উঠে যাওয়া, পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়া, শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দীন কাজের ভোগান্তিসহ প্রাণীকূলের দুর্দশা। ৩নং ওয়ার্ডে প্রান্ত দাসের ক্যামেরাবন্দি হয়েছে, আব্দুর রহমান নামের এক দিনমজুরের পরিবারের গল্প। তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন টিনের ছাউনির নিছে। বর্ষাকালে চালা ফুটে হয়ে পানি প্রবেশ করে তার ঘরে। সেই এলাকায় ৫ ফুট গভীরতার ড্রেনের ৪ ফুটই গৃহস্থ বর্জ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। যেকারণে ক্ষতিগ্রস্থ হন মাছ চাষীরাও। তেমনি একজন মোহাম্মদ সুমন শেখ। যার তিনটি ঘেরের মাছ পানিতে ডুবে ভেসে গেছে।
৪নং ওয়ার্ডে মো. আশরাফুল ইসলাম শ্রাবণের ক্যামেরায় উঠে এসেছে, নগরীর খুদের খালের দুরবস্থার ফলে ওই এলাকার জলাবদ্ধতার করুণ চিত্র। ৫ নং ওয়ার্ডের ফটোগ্রাফার মো. মারুফ সেখের বলেন, শহরের দারগাপাড়া এলাকাটি বেশ নিচু। বৃষ্টির সময় সেখানকার রাস্তা, ড্রেন, বাড়িঘর সবই প্লাবিত হয়। এলাকার বাসিন্দারা সেই পানির মধ্যেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। পানিতে কাজ করার ফলে ডলি বেগম, সেলিনা খাতুনের মত নারীদের পায়ে চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। যা স্বচিত্র তুলে ধরা হয়েছে প্রদর্শীতে।
৬নং ওয়ার্ডে মো. তানভীর হোসেন তুলে ধরেছেন, দূষিত পানিতে যাতায়াতের ফলে শিক্ষার্থীদের চর্মরোগে আক্তান্ত হওয়ার চিত্র। ৭নং ওয়ার্ডের ছবিতে দেখা গেছে জলাবদ্ধতার আরেক করুণ চিত্র। সেখানে বর্ষার পানিতে ড্রেন, ফাঁকা জায়গা, বসতঘর ও দোকানপাট সবই জলমগ্নতায় একাকার হয়ে যায়।
অন্যান্য এলাকার মত জলাবদ্ধতার ফলে সৃষ্ট দুর্দাশার চিত্র উঠে এসেছে ১৫ নং ওর্য়াডে লাবনী আক্তারের ক্যামেরায়। তার বর্ণনায় ফুটে উঠেছে শহরের দোকানী আসমা বেগম ও তার প্রতিবেশী রাহেলার দোকানের জলাবদ্ধতার চিত্র। যার কারণে ক্রেতারা তাদের দোকানে যাচ্ছেন না। আবার আসমা বেগম নামের এক গর্ভবতী নারী জলাবদ্ধ রাস্তা পাড়ি দিতে গিয়ে পিছলে পড়ে আঘাত পেয়েছেন।
নগর উন্নয়নের ফলে সৃষ্টি জলাবদ্ধতার সমস্যার বিষয়বস্তু উঠে এসেছে ১৮ নং ওয়ার্ডে নাইমুল ইসলামের ক্যামেরায়। সেখানের বাসিন্দা বীণা বেগমের উদ্ধৃতি দিয়ে তার ছবির বর্ণনায় আছে – রাস্তার কাজের সময়ে ড্রেনে মাটি পড়ে ভরাট হয়ে যায়। ফলে যেসব জায়গায় আগে বৃষ্টির শেষে পানি জমতো না, বর্তমানে সেসব জায়গায়ও বৃষ্টির পরে ১০ থেকে ১২ ঘন্টা জলাবদ্ধতা স্থায়ী হচ্ছে। এই অবস্থায় নগরীর পরিবাবান্ধব ব্যাটারি চালিত তিন চাকার বৈদ্যুতিক যাবনহনও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। যার ফলে গণপরিবহন সেবা ব্যাহত হচ্ছে।
নতুন ভবন নির্মাণে যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় জলাবদ্ধতার শিক্ষার হচ্ছে নগরীর ২৮নং ওয়ার্ডের কিছু এলাকা। ফটোগ্রাফার সামিয়া ইসলামের ক্যামেরায় ফুটে উঠেছে সেই চিত্র। তার বর্ণনায়, বর্তমানে উচু ভবন নির্মাণের জন্য ভিতও উচু করে নির্মাণ করা হয়। ফলে পানি প্রবাহের স্থান সংকুচিত হচ্ছে যাচ্ছে। অনেক খাল এখন ড্রেনে পরিণত হয়েছে। বর্ষাকালে অতিরিক্ত প্রবাহের কারণে পানি উপচে রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে। ড্রেনের বর্জ্য ও প্লাষ্টিক জমা হওয়ায় সেই পানি প্রবেশ করে নিচু বাড়িগুলিতে। ঝরনা বেগম নামের এক নারীর উদ্ধৃতিতে দিয়ে তার ছবির ক্যাপশনে বলা হয়েছে, বৃষ্টির সময়ে রান্নাঘর, বাথরুমসহ ঘরের মধ্যে দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। সেই সময়ে রাস্তা ওই ড্রেনের ময়লা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। তখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায় তাদের আবসস্থল। ভিজে যায়, আসবাবপত্র ও জামাকাপড়।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড) এর অর্থায়নে খুলনা সিটি কর্পোরেশন (কেসিসি) ও এশিয়া রেজিলিয়েন্ট সিটিজ প্রকল্পটি খুলনা শহরে বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাক। সেই ধারাবাহিকতায় শহরের জলাবদ্ধতার বাস্তবতা শীর্ষক এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছে।
সোমবার বেলা ১১টার দিকে আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন খুলনা সিটি কর্পোরশনের প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কার তাজুল ইসলাম।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে আয়োজিত আলোচনা সভায় খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, এই আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে খুলনা শহরের দৃশ্যমান জলাবদ্ধতার ছবি ফুটে উঠেছে এবং জলাবদ্ধতা নিরসনে সকলে মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
কেসিসি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কার তাজুল ইসলাম বলেন, জলবদ্ধতা দূরীকরণ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য তরুণদেরকে এগিয়ে আসতে হবে এবং পরিকল্পিত শহর গড়তে হলে নাগরিকদের সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে।
ইউএসএআইডি প্রতিনিধি জাহিদ ফারুক বলেন, শহরকে সুন্দর, পরিবেশ সম্মত ও বসবাস উপযোগী করে তুলতে হলে কেসিসি এর পাশাপাশি জনসাধারণকে ও সচেতন ও এগিয়ে আসতে হবে।
ব্র্যাকের আরবান ডেভেলপমেন্ট, ক্লাইমেট চেইঞ্জ এবং ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রাম এর পরিচালক মো. লিয়াকত আলী বলেন, খুলনা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে জলবায়ু পরিবর্তনের বৈজ্ঞানিক বিষয় ও সামজিক প্রেক্ষাপট এর সংমিশ্রন ঘটানো জরুরী। শহরের পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা জোয়ার-ভাটার সাথে সম্পর্কযুক্ত, খুলনার পরিকল্পনায় স্থানীয় জ্ঞান ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা প্রয়োজন।
প্রকল্পের প্রধান ফারহানা আফরোজ বলেন, এশিয়া রেজিলিয়েন্ট সিটিস প্রকল্প খুলনা শহরসহ এশিয়ার আরো পাঁচটি শহরে কাজ করছে, মুলত এই প্রকল্পের মাধ্যমে খুলনা শহরের টেকসই উন্নয়ন তথা রেজিলিয়েন্ট শহর বিনির্মানে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রদর্শনী উদ্ধোধনী অনুষ্ঠানে ৪০০ জনেরও বেশী তরুণ, স্কুল শিক্ষর্থী, সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও অন্যান্য গণ্যমাণ্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।