পুরোপুরি কার্যকর হয়ে উঠতে এখনও কেন হিমশিম খাচ্ছে ডিএমপি?
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, লুটপাট-ভাংচুর এবং অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এরপর পুলিশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কারের উদ্যোগের মধ্যে ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করাসহ শুরু হয় ঢালাওভাবে বদলি।
তবে এখনও আগের মতো স্থিতিশীলতা ও কর্মদক্ষতায় ফিরতে পারেনি পুলিশ। যার প্রমাণ মেলে ঢাকা শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নজর দিলেই।
ডিএমপির তথ্য অনুসারে, গত দুই মাসে ৬৮ জন খুন হয়েছেন। যদিও হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে ১৯২টি—যার মধ্যে অধিকাংশ মামলা দায়ের করা হয়েছে ৫ আগস্টের আগের ঘটনায়। এছাড়া, ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১০টি। ছিনতাই মামলা ৩৫টি, অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৭টি এবং সিদেল চুরির মামলা হয়েছে ৮১টি।
শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ডিএমপির ৫ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও দুই সহকারী পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তবে তারা কেউই নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হয়নি। নাম প্রকাশ না শর্তে তারা জানান, বদলি হয়ে আসা অধিকাংশ পুলিশ সদস্য ঢাকা শহরের অলিগলি চেনেন না; এছাড়া, জেলার তুলনায় অত্যাধিক কাজের চাপ, জনবল ও গাড়ি সংকটও রয়েছে।
এর পাশাপাশি পুলিশ সদস্যদের এখনো মামলার আতঙ্ক কাটেনি। ফলে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এখনও আগে মতো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না পুলিশ বাহিনী।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলির ঘটনায় পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তারও হয়েছেন। সম্প্রতি আবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে জুলাই আন্দোলনে ডিএমপিতে মাঠ পর্যায়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ডিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সময় ডিউটিতে থাকা অনেক পুলিশ কর্মকর্তা এখনো ঢাকায় রয়েছেন। নতুন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তথ্য চাওয়ার পর সবার মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
"মামলা, বদলি এমনকি চাকরি নিয়েও অনেকে শঙ্কায় রয়েছেন। কারণ সম্প্রতি পাঁচটি বিসিএস-এ নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের পুনঃরায় ভেরিফিকেশন শুরু হয়েছে।এই চাপ নিয়ে পুরোদমে কাজ করা কঠিন," যোগ করেন তিনি।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকাররে সময়ে ৫ বিএসএস পরীক্ষায় নিয়োগ পাওয়া পুলিশ সদস্যদের পুনরায় ভেরিফিকেশন শুরু করেছে পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
এ সময় নিয়োগ পাওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ সদস্য—যিনি ডিএমপির একটি ডিভিশনে কর্মরত রয়েছেন—বলেন, "পারিবারিকভাবে আমরা কোনো রাজনৈতি দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে ওই সময় নিয়োগ পাওয়া সবাই আওয়ামী লীগের লোক। নতুন এই ভেরিফিকেশনের ফলে আতঙ্ক কাজ করছে। এ সময় চাকরি হারালে পরিবার-পরিজন নিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়বে।"
জনবল সংকট ও গাড়ি সংকট
হাসিনা সরকারের পতনের পর ঢালাও বদলির কারণে ডিএমপিতে জনবল সংকট তৈরি হয়েছে। এছাড়া, গাড়ি সংকটও রয়েছে ডিএমপির আওতাধীন থানাগুলোতে।
এক সময় যেখানে এক একটি থানায় গাড়ি ছিল ৬–৭ টি, সেখানে এখন গাড়ি আছে ৩–৪টি। তার মধ্যে বেশিরভাগই আবার পুরাতন।
ডিএমপির আওতাধীন যাত্রবাড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, "আমাদের গাড়ি আছে ৪টি। এরমধ্যে একটি গাড়ি ডিএমপি থেকে ৫ আগস্টের পর দেওয়া হয়েছে। বাকি ২টি তেজগাঁও থানা থেকে ধার করা।"
বদলিজনিত কারণে থানায় পুলিশ সংকট দেখা দিয়েছে জানিয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালেদ মানসুর বলেন, "আমাদের থানায় পর্যাপ্ত কনস্টেবল নাই। তবে পোস্টিং অনেকের হয়েছে। আশা করছি, সবাই যোগ দিলে দ্রুতই এই সংকট কেটে যাবে।"
এদিকে, কর্মকর্তা সংকট এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ডিএমপির বেশির ভাগ ইউনিট। ডিবি পুলিশ ও ট্রাফিক পুলিশের ৮টি বিভাগের সবকটিতে উপ-কমিশনার পদায়ন করা সম্ভব হয়নি। প্রতি ২টি বিভাগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন উপ-কমিশনার।
ডিবি রমনা বিভাগের অর্গানোগ্রাম অনুযায়ী—একজন উপ-কমিশনার, তিনজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও দুইজন সহকারী কমিশনার থাকার কথা। রদবদলের প্রায় তিনমাস হতে চললেও এতোদিনে সেখানে পদায়ন হয়েছে একজন অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ও একজন সহকারী কমিশনারকে। আর রমনা ও মতিঝিল বিভাগ মিলিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন উপ-কমিশনার।
ঢাকার পরিবেশে মানিয়ে নিতে চ্যালেঞ্জের মুখে অধিকাংশ পুলিশ সদস্য
রাজশাহী থেকে ডিএমপিতে বদলি হয়ে আসা এক উপ-পরিদর্শক (এসআই) বলেন, "ঢাকার রাস্তাঘাট চিনতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। রাজশাহীতে সব কিছু জানাশোনা ছিল, ফলে সমস্যা মনে হয়নি। কিন্তু ঢাকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে উঠতেও কষ্ট হচ্ছে। তার ওপর অতিরিক্ত কাজের চাপ।"
''পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার বদলি নিয়ে চলে যাওয়া ইচ্ছে আছে" যোগ করেন তিনি।
খাগড়াছড়ি থেকে রমনা ডিভিশনে আসা এক পুলিশ উপ-পরিদর্শক বলেন, "ঢাকায় এই প্রথমবার বদলি হয়ে এসেছি। এখানকার সবকিছুই নতুন। কাজের চাপও বেশি। খাগড়াছড়িই ভালো ছিল।"
সিরাজগঞ্জ থেকে বদলি আসা এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, "এখানে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে বেগ পেতে হচ্ছে, কারণ এখানে থানা পুলিশের সোর্স নেই বললেই চলে।"
বদলি হয়ে আসা পুলিশ সদস্যরা যে ঢাকার পরিবেশে মানিয়ে নিতে বেগ পাচ্ছেন সেটি স্বীকার করেছেন খোদ অন্তর্বতী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বিশেষায়িত ইউনিটে দক্ষ জনবল সংকট
ডিএমপিতে জঙ্গি দমনে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) নামে একটি বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে। এই ইউনিটের সদস্যরা বোমা ডিসপোজাল ও সাইবার সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষায়িত ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এই ইউনিটের অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকেও বদলি করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এই ইউনিটের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "সিটিটিসির অধীনে থাকা বিভিন্ন ডিভিশনে নতুন অফিসার আসছেন। তাছাড়া, তাদের অধস্তনদের মধ্যেও অনেকে নতুন। তাদেরকে বিশেষায়িত এই ইউনিটের জন্য নতুন করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।"
"এছাড়া যেসকল পুলিশ অফিসারকে সরকারি টাকা ব্যয় করে বিশেষ এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হল, তারা অন্য জেলায় গিয়ে এই দক্ষতা কতটুকু লাগাতে পারবেন?" প্রশ্ন রাখেন তিনি।
নতুন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জঙ্গি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে ইউনিটের সদস্যদের বেগ পেতে হবে বলে উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসি প্রধানকে মুঠোফোন কল করা হলেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।
গতকাল টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) ফারুক হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি হচ্ছে এবং ডিএমপিও ধীরে ধীরে জুলাই-আগস্টের অস্থিরতার দাগ কাটিয়ে উঠছে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলছেন, পুলিশ সদস্যরা এখনো ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার ওপর ঢালাও বদলি তো রয়েছেই। এ অবস্থায় পুরোদমে কর্যকর করতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জন সম্পৃক্তা বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।