খাবার আলুর দাম বেশি হওয়ায় খাওয়া হচ্ছে বীজ আলু, উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা
বাজারে খাওয়ার আলুর দাম বেশি হওয়ায় বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া বীজ আলুর সরবরাহেও রয়েছে ঘাটতি। ফলে ডিসেম্বরে শুরু হতে যাওয়া আসন্ন মৌসুমে আলুর উৎপাদন ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, অক্টোবর শেষে দেশে বীজ আলুর মজুত ছিল ৫.৬৭ লাখ টন। আর বীজ আলুর চাহিদা ছিল ৭.৫ লাখ টন। অর্থাৎ ইতিমধ্যেই প্রায় ২ লাখ টন বীজ আলুর মজুত খাওয়ার আলু হিসেবে ব্যবহার হয়ে গেছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানেন, এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, এই সময়ে খাবার আলুর মজুত ছিল ৩.২০ লাখ টন।
এই পরিস্থিতে কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা আসন্ন মৌসুমে আলুর উৎপাদন ঘাটতির আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ সিড অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব আলী আফজাল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বাজারে প্রতি কেজি খাবার আলু বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা বা তারও বেশি দামে। কিন্তু প্রকারভেদে বিভিন্ন কোম্পানি বীজ আলু বিক্রি করছে ৬৯ থেকে ৭৮ টাকা কেজি দরে। ফলে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার হওয়ার।'
এমনটা হলে বীজ আলুর ব্যপক সংকট তৈরি হবে বলে সতর্ক করেন তিনি।
আফজাল আরও বলেন, বীজ আলু যা আছে, তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা প্রয়োজন। চাষিদের কাছে অল্প কিছু বীজের জোগান থাকে। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি) ও বেসরকারি খাত বীজ আলুর জোগান দেয়।
এছাড়া ২০-৩০ হাজার টন বীজ আমদানি হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমদানির বীজ ঠিক সময়ে দেশে না এলে সমস্যায় পড়তে হবে। এজন্য ঋণপত্র (এলসি) খুলতে যে সমস্যা হচ্ছে, দ্রুত তার সমাধান চান এই উদ্যোক্তা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৪.৫৭ লাখ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়; যেখানে উৎপাদন হয়েছে ১.০৬ কোটি টন। তবে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, এ সময়ে আলুর উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮০-৮৫ লাখ টন।
বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু টিবিএসকে বলেন, 'একদিকে আলুর উৎপাদন কম হয়েছে। সে কারণে বাজারে দাম বেশি। এই দাম বেশি হওয়ার কারণে এবারে অনেক বীজ আলু খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার হয়েছে এবং হচ্ছে।'
তিনি বলেন, 'কৃষি মন্ত্রণালয় অবশ্য বীজ আলুর যাতে যথাযথ সরবরাহ সংরক্ষণ করা যায়, সেজন্য আমাদেরকে নির্দেশনা দিয়েছে।'
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে খাবার আলুর চাহিদা ৮০ লাখ টনের কাছাকাছি। এর সঙ্গে সাড়ে ৭ লাখ টন বীজ আলুর চাহিদা রয়েছে।
সাধারণত প্রতি বছর আলুর দাম উৎপাদন মৌসুমে ২০-৩০ টাকা এবং মৌসুম শেষে ৪৫-৫০ টাকায় ওঠে। কিন্তু এ বছর উৎপাদন মৌসুম থেকেই আলুর দাম চড়া; এখন সেটি ৭০-৭৫ টাকায় উঠেছে।
এর মধ্যে সরকার আলু আমদানির ওপর থেকে শুল্ক কমিয়ে আমদানি সহজ করেছে। কিন্তু আমদানি করেও বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ উইংয়ের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত ৪.৫৫ লাখ টন আলু আমদানির অনুমতিপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে আমদানি হয়েছে মাত্র ৪১ হাজার টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, গত বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাংলাদেশ রপ্তানির পরিবর্তে নিয়মিত আমদানি করেও বাজার সামাল দিতে পারছে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, শুধু বীজ আলু নয়, খাবার আলুর সংকটও প্রকট হয়েছে। দুই দফা বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে এবারে কৃষক আগাম আলু রোপণ করেছেন কম পরিমাণে। প্রতি বছর নভেম্বর মাসে আগাম নতুন আলু বাজারে এলেও এ বছর এর পরিমাণ খুবই সামান্য।
ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার বিশ্লেষণের হিসাবে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছর এখন আলুর দাম ৩৪.৯২ শতাংশ বেশি।
এই পরিস্থিতিতে বীজ আলুর সংকট নিয়ে ১২ নভেম্বর কৃষি মন্ত্রণালয়ে সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়েছে। ওই সভায় সরকারি-বেসরকারি খাতের সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় বীজ আলু ও খাবার আলুর তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা হয়। এখন প্রকৃতপক্ষে বীজ আলু কত আছে, তার প্রকৃত তথ্য প্রদান এবং বীজ আলু যাতে কোনোভাবেই খাবার আলু হিসেবে ব্যবহার না করা হয়, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগকে সতর্ক নজরদারি করতে নির্দেশনা দেওয়া হয় সভায়।
সভায় কৃষি সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বীজ আলুর যথাযথ সংরক্ষণ ও সঠিক হিসাব দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রদানের নির্দেশনা দেন। একইসঙ্গে বীজ আলু যাতে অন্য কোনো খাতে ব্যবহার না হয়, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগকে তদারকি জোরদারের নির্দেশ দেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোল্ড স্টোরেজগুলোতে বর্তমানে আলুর মজুত রয়েছে ২ লাখ টনের কিছু বেশি, যা দিয়ে হয়তো ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলবে। তবে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে বাজারে আগাম আলুর ভালো সরবরাহ আসবে বলে মনে করা হচ্ছে।