জাহাজ থেকে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিংয়ে সরাসরি তেল স্থানান্তর শীঘ্রই, পরিচালনার দায়িত্ব পাচ্ছে চীনা কোম্পানি
কক্সবাজারের মহেশখালিতে দেশের প্রথম সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) সিস্টেম পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া ছাড়াই চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডকে জিটুজি-ভিত্তিতে (গভর্নমেন্ট-টু-গভর্নমেন্ট) নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, চীনা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এ কোম্পানির সঙ্গে প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'তবে এর মানে এমন নয় যে, আমরা উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া থেকে সরে আসছি।'
তিনি আরও জানান, এসপিএম দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় পড়ে রয়েছে। এটি আপাতত চীনা কোম্পানির মাধ্যমে চালু করা হবে। 'পরে আমরা আমাদের নিজস্ব লোকবলকে প্রশিক্ষণ দেব। কাজটি দ্রুত করার জন্যই জিটুজি পদ্ধতিতে যেতে হচ্ছে,' বলেন তিনি।
দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য আমদানি করা জ্বালানি তেল (পেট্রোলিয়াম) খালাস দ্রুত, সহজ ও সাশ্রয়ী করার জন্য ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইদ ডাবল পাইপলাইন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
মাতারবাড়ি থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভাসমান স্থাপনাটি ১১০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডবল পাইপলাইনের মাধ্যমে সংযুক্ত—এর ৭৩ কিলোমিটার সমুদ্রে এবং বাকি ৩৭ কিলোমিটার ভূমিতে। এ পাইপলাইনটি দিয়ে সমুদ্রে থাকা বড় জাহাজ থেকে মহেশখালীতে স্টোরেজ ট্যাঙ্কে পরিশোধিত তেল ও ডিজেল পরিবহন করা হবে।
তবে, অপারেটর নিয়োগে দেরির কারণে মার্চ মাসে চালু হওয়ার পর থেকে আট হাজার ২৯৮ কোটি টাকার এ সিস্টেমটি সাত মাস ধরে নিষ্ক্রিয় পড়ে ছিল।
এর আগে মে মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় চীনা কোম্পানিটি নিয়োগ পাওয়ার প্রক্রিয়ায় ছিল। তবে ৫ আগস্ট শাসনক্ষমতা পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার এ আইনের অধীনে সকল আলোচনা এবং ক্রয় প্রক্রিয়া স্থগিত করে।
এ স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জিটুজি চুক্তির মাধ্যমে চীনা কোম্পানিকে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। জ্বালানি বিভাগ ও বিপিসি উভয়ের সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, চুক্তির প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে এবং উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান তা অনুমোদনও করেছেন।
শিগগিরই এ প্রস্তাব অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটিতে উপস্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদিত হলে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে খরচ নিয়ে আলোচনা হবে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, তিনটি বৈধ ব্যবসায়িক পদ্ধতি রয়েছে: উন্মুক্ত দরপত্র, জিটুজি এবং পিপিপি (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ)। 'এ তিনটি পদ্ধতিই আমাদের জন্য ভ্যালিড [আইনত বৈধ],' তিনি বলেন।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হতে পারে, যেখানে নতুন কোম্পানিও প্রতিযোগিতায় আসতে পারে। তবে, চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং ইতোমধ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে, তাই তাদের সঙ্গেই এগিয়ে যাওয়াই যৌক্তিক।
'সেজন্য আমরা তাদেরকেই দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু আমরা দাম ও প্রযুক্তি স্থানান্তরের বিষয়টি দেখব। যাতে ভবিষ্যতে আমরা নিজেরা এটি ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা করতে পারি,' বলেন এ উপদেষ্টা।
যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ এবং বুয়েটের অধ্যাপক এম শামসুল হক সতর্ক করে বলেছেন, সরাসরি ক্রয় পদ্ধতি এবং জিটুজি চুক্তিতে স্বচ্ছতার অভাব থাকে। তিনি বলেন, এসব চুক্তি প্রায়ই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়, যা প্রকৃত খরচ বৃদ্ধি এবং মূল্য নির্ধারণে অস্বচ্ছতা সৃষ্টি করতে পারে।
'বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে মিটিং করা হলেও মূলত অভ্যন্তরীণ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে দাম নির্ধারণ করে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের ব্যয় অনেক বেড়ে যায় এবং কিছু কিছু লোকের স্বার্থ ঢুকে যায়,' বলেন এ অধ্যাপক।
বর্তমানে, আমদানিকৃত পেট্রোলিয়াম তেল গভীর সমুদ্র থেকে লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে উপকূলে পরিবহন করা হয় এবং সারাদেশের স্টোরেজ স্থাপনাগুলোতে বিতরণ করা হয়।
সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং চুক্তি
২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল চার হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে। কিন্তু দেরি ও বাজেট সংশোধনের কারণে প্রকল্পের খরচ বেড়ে দাঁড়ায় আট হাজার ২৯৮ কোটি টাকায়। এখন এটি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং নির্মাণ কাজ শেষ করলেও চুক্তিতে অপারেশনাল প্রশিক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ সাধারণত যে কোম্পানি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তারাই এটি পরিচালনা করে ও স্থানীয় জনবলকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
এ বিষয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, এটি একটি 'ভিন্ন রকম' চুক্তি। তিনি বলেন, '[চীনা] কোম্পানিটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে, কিন্তু পরিচালনার বিষয়টি চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল না।'
'অপারেশন বা পরিচালনা ছাড়া এ প্রকল্প এখন অর্থহীন। তেল তো মুভ [স্থানান্তর] করতে হবে। এটা একটা আনইউজুয়াল কন্ট্রাক্ট আরকি,' বলেন উপদেষ্টা।
জ্বালানি ও বিদ্যুৎখাতে শেখ হাসিনা সরকারের সময় স্বাক্ষরিত জিটুজি চুক্তির ব্যয় পর্যালোচনা করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক ম. তামিম।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রকল্পগুলো বিশ্লেষণ করে আগের সরকারের আমলের একটি বিশেষ প্যাটার্ন দেখা গেছে।
'জিটুজি প্রকল্পের জন্য একটি বেঞ্চমার্ক নির্ধারণ করা হতো। প্রকল্পব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে ওই বেঞ্চমার্কের চেয়ে সামান্য কমে প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু এতেও জিটুজি প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেশি নির্ধারণ করে দুর্নীতি করা হতো,' বলেন তিনি।
দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের জন্য উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদার নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও প্রকল্প ব্যয় অনেক বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হতো বলেও জানান তিনি।
জ্বালানি বিভাগের যুক্তি
অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপনের জন্য জ্বালানি বিভাগের তৈরি করা একটি সারসংক্ষেপে চীনা কোম্পানিটিকে জিটুজি-ভিত্তিতে ঠিকাদার নিয়োগের পক্ষে বেশকিছু যুক্তি তুলে ধরেছে জ্বালানি বিভাগ।
এটি ব্যাখ্যা করে বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় প্রকল্পে অপারেটর বা ব্যবস্থাপনা ঠিকাদার নিয়োগ স্থগিত করা হলেও ক্রয় বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের পর পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৮-এর অধীনে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
বিভাগটি আরও বলেছে, কোনো অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি না থাকলে প্রকৌশল এবং পরামর্শদাতা ঠিকাদাররা চলে যাওয়ার পর সাইটের যত্ন এবং কাস্টডি বিষয়ক ঝুঁকি তৈরি হবে।
দীর্ঘদিন অচল থাকলে প্রকল্পের যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের লাইটারেজ জাহাজ দু'টির অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ – একটি ইতোমধ্যে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এ জাহাজগুলোর যেকোনো সময় ব্রেক-ডাউন রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে। এতে তেল খালাস প্রক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হতে পারে বলেও জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ।
বিষয়টি জরুরি বিধায় ইন্সটলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং-এর অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ পরিচালনার জন্য সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে নিয়োগের বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেছে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ।