বগুড়ায় দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্র: কৃষি প্রবৃদ্ধিতে এক অনুঘটক
বাড়ির পাশে পরীক্ষামূলকভাবে বস্তায় আদা চাষ করে সুফল পেয়েছেন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার অনাহত গ্রামের তরুণ উদ্যোক্তা রুহুল আমীন। ২২ বস্তায় আদা চাষের পর এবার পরিসর বাড়াতে চান।
রুহুল জানালেন, বস্তায় আদা চাষ ইউটিউব দেখে শিখেছেন। কম পরিশ্রমে দারুণ চাষ পদ্ধতি। এখন তিনি আদা চাষ করতে চান বাণিজ্যিকভাবে। প্রযুক্তিগত বিষয়াদির বিস্তর জানতে বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র এসেছেন তিনি।
গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, কৃষিতে দিন দিন প্রযুক্তির চাহিদা বাড়ছে। শিক্ষিত মানুষেরা এখন কৃষির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছেন। রুহুলের মতো অনেকেই প্রতিনিয়ত পরামর্শ নিতে আসছেন। তারা উপকৃত হচ্ছেন। এতে বাড়ছে উৎপাদনও।
কৃষি বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য মতে, ভারতীয় উপমহাদেশে মসলার আদি ব্যবহার ছিল মূলত রং ও ওষুধ হিসেবে। ঔষধি গুণের কারণেই এক সময় এটি খাদ্যপণ্যের সাথে অবিচ্ছেদ্য উপাদান হয়ে ওঠে। এ উপমহাদেশে আগে দারুচিনি, কালো মরিচ চাষাবাদ হওয়া শুরু হয়। বাড়তে থাকে কদর। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় কিছু উদ্ভিদ থেকে মসলা সংগ্রহ করা হয়।
বিশ্বজুড়ে ১১৩টি মসলার চাষাবাদ হলেও বাংলাদেশে হয় প্রায় ৩০ ধরনের।
মসলা গবেষকরা বলছেন, দেশে প্রায় ৪.২৯ হেক্টর জমিতে মসলা চাষ হয়। উৎপাদিত মসলার পরিমাণ প্রায় ৩৫.৯৩ টন। অর্থাৎ, বিশ্বের প্রায় ৯ শতাংশ মসলা দেশে উৎপাদিত হয়।
দেশে মসলার মোট চাহিদা ৫৮ দশমিক ৫০ লাখ মেট্রিক টন। এরমধ্যে আমদানি হয় ৪৪ দশমিক ৯৬ লাখ মেট্রিক টন। এরপরেও ঘাটতি থেকে যায় আরও ১৩ দশমিক ৫৪ লাখ টন।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে গবেষকেরা জানান, দেশে বছরে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার মসলা আমদানি করা হয়।
আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশে মসলা নিয়ে দিনদিন গবেষণা হচ্ছে। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে কৃষি ও কৃষকবান্ধবের জন্য কাজ করছে গবেষণা কেন্দ্র।
বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্র
১৯৯৬ সালে বগুড়া থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে মহাস্থানগড়ের অদূরে শিবগঞ্জের রায়নগর এলাকায় ৭০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র মসলা গবেষণা কেন্দ্র। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) অধীনে এ গবেষণা কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।
বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রের অধীনে তিনটি আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র ও চারটি উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। আঞ্চলিক মসলা কেন্দ্র মাগুরা, কুমিল্লা ও গাজীপুরে। উপ-আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র লালমনিরহাট, ফরিদপুর, সিলেট ও খাগড়াছড়িতে।
গত দুই যুগে এই মসলা গবেষণা কেন্দ্র থেকে ৫৮টি জাত ও ১৫৬টি মসলা ফসলের প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে। এরমধ্যে পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, আদা, হলুদ, ধনিয়া, কালোজিরা, মেথি, ফিরিঙ্গী, মৌরি, রাধুনী, জাউন, চিভে, পুদিনা, আলুবোখারা, দারুচিনি, গোলমরিচ, পান, জিরাসহ আরও উন্নত জাত উদ্ভবন করা হয়েছে এই গবেষণা কেন্দ্র থেকে। এগুলো কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদও হচ্ছে।
গবেষণা কেন্দ্রের পরামর্শে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার দেউলী ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম আট শতক জমিতে এবার জিরার চাষা করেছেন।
তিনি বলেন, "কৃষি অফিসের পরামর্শে এবার অল্প জমিতে প্রথমবার জিরার চাষ করা হয়েছে। জিরার চারাও বেশ ভালো রয়েছে। এবার ভালো ফল পেলে আগামীতে বাণিজ্যিকভাবে জিরার চাষ করব।"
দেশে জিরা উৎপাদন ও কৃষক পর্যায়ে বিস্তারে কাজ করছেন মসলা গবেষণা কেন্দ্রের সিনিয়র সায়েন্টিফিক কর্মকর্তা (হর্টিকালচার) ডা. মাহমুদুল হাসান সুজা।
তিনি বলেন, এক সময় কৃষকদের ধারণা ছিল ভূমধ্যসাগরীয় মরু ফসল জিরা জলবায়ুগত কারণে বাংলাদেশে উৎপাদন করা যায় না। কিন্তু সেই ধারণার পরিবর্তন হয়েছে।
"চলতি মৌসুমে দেশের ১৭টি জেলায় ৮০ জন কৃষক এবার জিরা চাষ করছেন। জিয়া চাষে ধানের চেয়ে ৪ গুণ লাভ হওয়ার সম্ভবনা আছে," যোগ করেন তিনি।
পেঁয়াজ বাজারের অস্থিরতা মোকাবেলা
হলুদ, শুকনা মরিচ, জিরা, ধনিয়ার সাথে আদা-রসুন পেঁয়াজ গুড়ার তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছে বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্র।
প্রক্রিয়াজাত করে কাঁচা পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে পেঁয়াজ গুঁড়া ব্যবহার করা যাবে। সম্পূর্ণ দেশীয় এই পদ্ধতিতে উদ্যোক্তারা পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদন করতে পারবেন, সংরক্ষণও করতে পারবেন সহজেই।
গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেঁয়াজ গুঁড়া উৎপাদন প্রক্রিয়া ছড়িয়ে দিতে পারলে আমদানি না করেও দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ দিয়েই সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে বছরে পেঁয়াজের উৎপাদন গড়ে ২৫ লাখ টনের মতো। এরমধ্যে সংরক্ষণ পর্যায়ে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ; অর্থাৎ, ছয় থেকে সাত লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়।
কিন্তু দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৫ লাখ টনেরও বেশি। এই হিসাবে দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। এ কারণেই এই পণ্যের বাজার আমদানি নির্ভর। আমদানি ব্যাহত হলেই সংকট তৈরি হয় পেঁয়াজের বাজারে। সংকট সমাধানে পেঁয়াজের গুড়া সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রে ড. মাসুদ আলমের তত্ত্বাবধানে গবেষণাগরে পেঁয়াজের গুড়া উৎপাদন করা হয়।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ নিয়ে গবেষণারত এই বিজ্ঞানী জানান, অনেক দেশে পেঁয়াজের গুড়ার প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে নেই। কিন্তু দেশের আবহাওয়ায় কেউ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পেঁয়াজের গুড়া করে না। আবার পেঁয়াজের দামও বিভিন্ন সময় ওঠানামা করে।
"এ কারণে দেশে পেঁয়াজের গুড়ার বাজার তৈরি করার সুযোগ রয়েছে উদ্যোক্তাদের। নতুন এই উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে দেশে উদ্যোক্তা গড়ে তোলা সম্ভব। এতে বাঁচবে দেশের অর্থনীতিও," বলেন তিনি।
এদিকে, দেশে শীতকালীন পেঁয়াজের উৎপাদন যথেষ্ট হলেও উপযুক্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা এবং গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষ সেভাবে হয় না। এ কারণে কারণে প্রতিবছর আগস্ট থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়কাল বিদেশি আমদানি বন্ধ হলেই পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট বলছে, দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ৩৫ লাখ মেট্রিক টন। এর সব মিলে এখন উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৩০ হাজার টন। গড়ে ঘাটতি থাকে ৫ লাখ টন মতো। ঘাটতি মেটানো হয় দেশের বাহির থেকে রপ্তানি করা হয়। এই রপ্তানি নির্ভরতা কমাতে গবেষণা কেন্দ্র গ্রীস্মকালীন পেঁয়াজ চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে।
বিষয়টি সামনে নিয়ে মসলা গবেষণা কেন্দ্র এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আবিষ্কার করে বারি পেঁয়াজ-৫, যা সারা বছরই চাষ করা যায়। চাষীদের উদ্যোগী করতে মাঠে চাষের পাশাপাশি স্বল্পপরিসরে ছাদেও চাষ করা হচ্ছে বারি পেঁয়াজ-৫।
বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. নুর আলম চৌধুরী বলেন, "বিদেশি আমদানি নির্ভরশীলতা কমাতে, গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের চাষাবাদ বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। গ্রীস্মকলীন পেঁয়াজের চারা তৈরি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমরা গবেষণা করে চারা উৎপাদনে সফল হয়েছি। দেশের অনেক জেলায় এখন গ্রীস্মকালীন পেঁয়াজ চাষাবাদ হচ্ছে।"
নতুন প্রযুক্তি
মসলা গবেষণা কেন্দ্রে কৃষকদের জন্য বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আছে। এখানকার গবেষকরা বিভিন্ন সময়ে কৃষকদের মাঝে এসব প্রযুক্তিগত চাষব্যবস্থার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তি হলো— ঢিবি ও বস্তা পদ্ধতিতে আদা রোপন , জিংক ও বোরন প্রয়োগে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের বীজ ধারণ, ফলন এবং গুণগত মান বৃদ্ধি, গ্রীষ্মকালীন মরিচ ও গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আন্তঃফসল চাষ, সমন্বিত পুষ্টি ও সেচ ব্যবস্থাপনায় রসুনের ফলন বৃদ্ধি, চারার মাধ্যমে হলুদ উৎপাদন, হলুদ ও মরিচের আন্তঃফসল চাষ, রোগের সমন্বিত দমন ব্যবস্থাপনা, স্টোরে পেঁয়াজের রোগজীবাণু ও বিভিন্ন জাতের পেঁয়াজের কন্দের পঁচন ও গজানোর হার নির্ণয় ইত্যাদি।
এছাড়া, চলতি মসলার সঙ্গে গবেষণাধীন অন্যান্য অপ্রচলিত মসলা ফসলগুলো হলো— শলুক, তেজপাতা, রাঁধুনী, জোয়ান, ফিরিঙ্গি, চুঁইঝাল, একাঙ্গি, পিপুল, শঠি, দই রং, বচ, পুদিনা, পোলাও পাতা, লেমনগ্রাস, আম আদা, মিঠা তুলশি, পান, সুপারি, জিরা, কাবাবচিনি, চিভস, অলস্পাইস, কারিপাতা, পান বিলাস, লবঙ্গ, পেস্তা বাদাম, জয়ফল, জৈয়ত্রী, ভ্যানিলা, রোজমেরী, বিলাতি ধনিয়া ইত্যাদি।
আগামীতে এই প্রতিষ্ঠান মসলা জাতীয় ফসলের উচ্চ ফলনশীল, পুষ্টিমান সম্পন্ন ও প্রতিকূল পরিবেশ সহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন, উন্নত, আধুনিক ও আরও টেকসই উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে চায়। একই সাথে উৎপাদিত মসলা ফসলের বাজার ব্যবস্থাপনা সমীক্ষা, পরিবর্তনশীল জলবায়ু মোকাবেলা করার জন্য স্বল্পসময়ে অধিক উৎপাদনক্ষম ও উচ্চ গুণাগুণ সম্পন্ন জাত, উন্নত উৎপাদন পদ্ধতি ও মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদনের লক্ষ্যও রয়েছে তাদের। জিরা, এলাচ ও দারুচিনির জাত উন্নয়নেও মসলা গবেষণা কাজ করছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন।
বগুড়ার মসলা গবেষণা কেন্দ্রে ১৩ জন বিজ্ঞানী গবেষণা করেন।
এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জুলফিকার হায়দার প্রধান বলেন, এখানে মসলা প্রযুক্তিসহ দেশের অনেক বিজ্ঞানী, কৃষি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মী ও কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। আবহাওয়াগত সমস্যা ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে দেশে মসলা চাষ বিস্তার লাভ করতে সময় লাগছে।
"তবে এরমধ্যেও এ কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত সকল জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাথে কাজ করা হচ্ছে। এর সুফল জনগণ পাচ্ছে," যোগ করেন তিনি।