চট্টগ্রামের পাহাড়ে পরীক্ষামূলক কফি চাষে সাফল্য, রপ্তানি সম্ভাবনার দিকে নজর
চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় প্রথমবারের মত 'রোভাস্টা' ও এরাবিক জাতের' কফির চাষে ভালো ফলন পেয়েছেন কৃষকরা। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
বছর দুয়েক আগে লাগানো গাছগুলোতে এ বছরই প্রথম ফলন হয়। বর্তমানে প্রতিটি গাছ থেকে ১ থেকে ১.৫ কেজি কফি বীজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো শুকিয়ে গাছ প্রতি ৪০০ থেকে ৬০০ গ্রাম কফি পাউডার পাওয়া যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে পাঁচটি উপজেলার প্রায় ৫০টি বাগানের ৪৬.৬৯ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে ৫১ হাজার ৭৫০টি কফির চারা রোপণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গাছে ইতোমধ্যেই ফল ধরেছে।
চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে এ বছর প্রায় ৩ টন কফি বীজ সংগ্রহ করা হবে বলে কর্মকর্তারা আশা করছেন। আগামী বছর এই উৎপাদন বেড়ে ৫ থেকে ৬ টনে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মতে, আর্দ্র ও ছায়াযুক্ত পাহাড়ি এলাকাগুলো কফি চাষের জন্য আদর্শ। এর জন্য আলাদা জমির প্রয়োজন হয় না। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার মাটি ও জলবায়ু কফি চাষের উপযোগী এবং এটি আম, লিচু, কলা বা পেঁপের মতো ফসলের সঙ্গে একত্রে চাষ করা যায়।
এই অঞ্চলে কফি চাষ সম্প্রসারিত হলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ, রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টি এবং কফি আমদানিতে ব্যয় হওয়া বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
আমদানি তথ্য অনুযায়ী, দেশে তিন ধরনের কফি– ইনস্ট্যান্ট, বীজ এবং রোস্টেড (ভাজা) কফি আমদানি করা হয়। ২০১২ সালে দেশে ২৬৪ টন কফি আমদানি করা হয়েছিল। এক দশকের মধ্যে আমদানি দ্রুত বেড়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ৭৬৭ টনে পৌঁছায়। এই বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ৫৬ শতাংশ।
তবে পরবর্তী বছরগুলোতে আমদানি কিছুটা কমে যায়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এটি ১ লাখ ৭৩২ টনে এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আরও কমে ১ লাখ ৪৩৯ টনে নেমে আসে। তা সত্ত্বেও ডিএই জানিয়েছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার টন কফির চাহিদা রয়েছে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে চালু হওয়া কফি ও কাজু চাষ সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া এবং রাউজানের পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ৪৬.৬৯ হেক্টর জমিতে কফি চাষ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে কৃষকদের বিনামূল্যে চারা, সার, কীটনাশক এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা হয়।
ডিএই কর্মকর্তারা জানান, কফি আম, লিচু, কলা কিংবা পেঁপে গাছের ফাঁকে রোপণ করা যায়। কফি গাছ প্রায় ৫.৫ ফুট উঁচু হয় এবং খুব কম যত্নেই বেড়ে ওঠে। বছরে একবার গাছ ছাঁটার পর দুই থেকে তিন বছরের মধ্যেই ফল দেয়।
শুরুতে প্রতি গাছে ১ থেকে ৫ কেজি কফি পাওয়া গেলেও আট বছর পর তা ৭ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সঠিক যত্নে এই গাছ ২০ বছর পর্যন্ত ফল দিতে সক্ষম।
২০১৯-২০ অর্থবছরে বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় ১১৮.৩ হেক্টর জমি থেকে ৫৫.৭৫ টন কফি উৎপাদন করে ডিএই। ২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে ৫৮ টনে পৌঁছায়। ২০২২-২৩ সালে তা আরও বেড়ে ৬২ টনে এবং ২০২৩-২৪ সালে সেটি ৬৭ টনে পৌঁছায়।
২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বড় কুমিরা এলাকায় কৃষক মোহাম্মদ বাবুলের বাগান পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, তার ১,২০০ কফি গাছ আম, লিচু, মাল্টা, পেঁপে ও কলা গাছের সঙ্গে চাষ করা হয়েছে।
বাবুল টিবিএসকে বলেন, "আমার বাগানের প্রায় সব গাছে ফুল ও ফল এসেছে। নভেম্বরের শুরুতে ফল সংগ্রহ শুরু করেছি। এখনো গাছে ফল রয়েছে। প্রতি গাছ থেকে ১ থেকে ১.৫ কেজি ফল পেয়েছি। প্রথমবারের ফলন হিসেবে এটি বেশ ভালো। আগামী মৌসুমে ২ থেকে ২.৫ কেজি ফলন হবে বলে আশা করছি।"
সীতাকুণ্ড উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "এ বছর আট ইউনিয়নের ১১.৬ হেক্টর জমির নয়টি বাগানে ৭ হাজার ৫০০টি কফি গাছ রোপণ করা হয়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ফলনে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "এই বছরের ফলন দেখে উৎসাহিত হয়ে অনেক কৃষক এখন কফি চাষে আগ্রহী।"
ডিএই চট্টগ্রামের অতিরিক্ত উপপরিচালক (ফসল) মো. ওমর ফারুক বলেন, "চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় কফি চাষের সাফল্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রামে কফি চাষ সম্প্রসারণের জন্য একটি প্রকল্প চালু করা হয়েছে।"
"চারা উৎপাদন খরচ কম, বিশেষ কোনো জমির প্রয়োজন হয় না এবং কফি চাষে খুব কম যত্নের প্রয়োজন হয়, যা এটিকে একটি লাভজনক ফসল হিসেবে গড়ে তুলেছে। বাজারে কফির দাম ভালো এবং এই অঞ্চলের কফির মান অত্যন্ত উন্নত," বলেন ওমর ফারুক।
তিনি আরও যোগ করেন, "গত বছর বান্দরবানের বগা লেক এলাকার একটি বাগানের কফি পরীক্ষা করা হয় এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এটিকে বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা সুস্বাদু কফি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতি আমাদের কফি চাষ সম্প্রসারণে উৎসাহিত করছে।"
ওমর ফারুক আরও বলেন, "দেশে ইতোমধ্যে কয়েকটি কফি প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন করা হয়েছে এবং নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স বাংলাদেশি কফি ব্র্যান্ডিং নিয়ে কাজ করছে।"
তিনি বলেন, "২০১৯-২০ অর্থবছরে শুরু হওয়া পাইলট প্রকল্পটি এ বছর শেষ হবে। সরকার যদি সব পাহাড়ি এলাকায় কফি চাষ সম্প্রসারণের জন্য নতুন প্রকল্প চালু করে, তাহলে আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিও শুরু করতে পারব।"
ডিএই বর্তমানে ২০২১-২০২৫ মেয়াদে ২১১ কোটি টাকার বাজেটে "কাজু ও কফি গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ" প্রকল্প চালাচ্ছে। এর লক্ষ্য, উন্নত জাতের চারা উদ্ভাবন, প্রযুক্তি স্থানান্তর, এবং ২৮ জেলার ৮৮ উপজেলায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান।
প্রকল্প পরিচালক শাহিদুল ইসলাম বলেন, "বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলায় প্রায় পাঁচ লাখ হেক্টর অব্যবহৃত জমি রয়েছে। এর মধ্যে এক লাখ হেক্টরে কফি চাষ করলে দুই লাখ টন কফি উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।"