অ্যাকাডেমির চেয়ে চাকরির পড়াশোনায় ব্যবহার বাড়ছে ঢাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের
শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারকে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার চেয়ে চাকরিমুখী পড়াশোনায় বেশি ব্যবহার করছে।
অ্যাকাডেমিক বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কম থাকায় এ সংক্রান্ত বইগুলোতে ধুলার আস্তরণ পড়েছে। নষ্ট হতে বসেছে দুষ্প্রাপ্য ও মূল্যবান অনেক সংগ্রহ।
ঢাবির শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩৭ হাজারের বেশি হলেও কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গ্রন্থাগার মিলিয়ে অধ্যয়নের জন্য আসন রয়েছে মাত্র ১ হাজার ৩০০টি। এরমধ্যে শুধু কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে রয়েছে ৭৪০টি আসন। সরেজমিনে দেখা যায়, এ সীমিত সংখ্যক আসনগুলোও ব্যবহৃত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের চাকরিমুখী পড়াশোনায়। তিন তলা বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রতিটি রিডিং রুমেই দেখা যায়, সকলেই চাকরির গাইড বই ও নোট পড়ছে। শিক্ষার্থীদের টেবিলে দেখা যায় সারি সারি চাকরির বই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এম আলাউদ্দিন আযাদ বাসসকে বলেন, আমাদের হলগুলোতে পড়াশোনার পর্যাপ্ত পরিবেশ নেই। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে পূর্ণ মনোযোগ সহকারে পড়া যায়। শিক্ষা জীবনের শেষ পর্যায়ে আছি। তাই এখন থেকেই চাকরির পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে হচ্ছে। কেবল বর্তমান শিক্ষার্থীরাই নন, সাবেক শিক্ষার্থীরাও এসে চাকরির পড়াশোনা করছেন এ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-২০১৮ সেশনের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী শাওনী ভৌমিক পূজা এক বছর আগে শিক্ষা জীবন শেষ করলেও চাকরির পড়াশোনার জন্য নিয়মিতই আসছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে।
তিনি বলেন, পড়াশোনা সম্পন্ন হলেও এখনো চাকরি পাইনি। এজন্য খুবই হতাশায় থাকতে হয়। কিন্তু লাইব্রেরিতে পড়াশোনার জন্য আসলে সবাইকে পড়তে দেখে উৎসাহ পাই। এতে হতাশাও কমে যায়।
এখানে পড়াশোনার পরিবেশও ভালো বলে জানান তিনি।
কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে দিনে দিনে বইয়ের সংগ্রহ বাড়লেও অ্যাকাডেমিক পড়াশোনায় বই ইস্যু করে পড়ার প্রবণতা ক্রমেই কমছে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের বই ইস্যুর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ৫ বছরে ধারাবাহিকভাবেই বই ইস্যুর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার (কেন্দ্রীয় ও বিজ্ঞান শাখা) থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ৩ লাখ ৩৫ হাজার ১০০ কপি, ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৫৫৯ কপি, ২০১৯-২০২০ শিক্ষাবর্ষে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৭৬১ কপি, ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে ১ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩২ কপি ও ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে মাত্র ২৫ হাজার ৭৮১ কপি বই ইস্যু করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী পাওয়া যায়, যারা লাইব্রেরিতে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার জন্য বই ইস্যু করে পড়েন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের চার বছরের পড়াশোনায় কখনই লাইব্রেরি থেকে বই ইস্যু করে পড়েননি। এমন চিত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে দেখা যায়। তবে যারা নিয়মিত অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার জন্য গ্রন্থাগারে যান, তাদেরকেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে নিয়মিত অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা করতে আসা শিক্ষার্থী রুপাইয়া শ্রেষ্ঠা বাসস-কে বলেন, অনেক সময়ই বসে বই পড়ার জন্য জায়গা পাওয়া যায় না। আসনগুলো সকাল থেকেই পূর্ণ থাকে। এতে পড়াশোনায় ও গবেষণার তথ্য নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সমস্যায় পরতে হয়। তবে আমাদের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারটি একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। এখানে বিপুল সংখ্যক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। এ লাইব্রেরিতে গবেষণার জন্য অনেক তথ্য পাওয়া যায়। এখানে বিদেশি অনেক বইয়ের একসেসও পাওয়া যায়। শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের এসব রিসোর্স ব্যবহারের বিরাট সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগগুলো শিক্ষাজীবনে আমাদের কাজে লাগানো উচিত।
গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মুদ্রিত বই, ৮ হাজার রেফারেন্স বই ও ১৩ হাজার ৭০০ ই-জার্নালসহ নিজস্ব সফটওয়্যারে প্রায় ৫০ হাজার বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। মুদ্রিত ও দুষ্প্রাপ্য বইগুলোর সংরক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের উপ-গ্রন্থাগারিক শামীম আরা বলেন, মুদ্রিত বইগুলো যতদূর সম্ভব নিরাপদভাবেই রাখা হয়েছে। দুষ্প্রাপ্য বইগুলোর তালিকা করা হচ্ছে। বইগুলো ক্যাটালগ করে ঠিক করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে সরেজমিনে দেখা যায়, মুদ্রিত বইগুলোতে পরেছে ধুলার আস্তরণ। দুষ্প্রাপ্য অনেক বই এতটাই জীর্ণ অবস্থায় দেখা গেছে যে, তা সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে মূল্যবান কপিটি পুরোপুরিভাবে নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আধুনিক লাইব্রেরি নির্মাণ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. রোকনুজ্জামান বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় পুরোপুরি আধুনিকায়ন সম্ভব নয়। এর জন্য পুরো ভবনটি পুনঃনির্মাণ করতে হবে। অ্যাকাডেমিক উদ্দেশ্যে আরও ব্যবস্থা নিতে হবে। ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে সমস্ত ই-রিসোর্স নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে হল ও সেমিনার লাইব্রেরির সাথে সরাসরি সংযোগ থাকবে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের। শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টাই লাইব্রেরি একসেস পাবে।
তিনি আরও জানান, শুধু অবকাঠামোর আধুনিকায়ন করলেই হবে না, শিক্ষার্থীদের লাইব্রেরি সফটওয়্যার ব্যবহারে প্রশিক্ষণও দিতে হবে। এজন্য দক্ষ জনশক্তিও প্রয়োজন।
শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় আধুনিক পরিবেশ নিশ্চিতে সাইলেন্ট জোন, গ্রুপ ডিসকাশন রুম ও স্টাডি কর্নার আলাদাভাবে নির্মাণ করতে হবে বলেও জানান তিনি।
গ্রন্থাগার সংস্কার ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি ও স্থায়ী সমাধান গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রধান গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল আলম বাসস-কে বলেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের বর্তমান ভবনটি ভেঙে ১২ তলা ভবন তৈরির অনুমোদন হয়েছে। একনেক-এ তা উপস্থাপন করা হয়েছে এবং পাশ হলেই এর সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে।
তিনি জানান, লাইব্রেরি মূলত অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা ও গবেষণার জন্য। কখনই চাকরির পড়াশোনার জন্য নয়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা চাকরিমুখী পড়াশোনার জন্য আসলে আমরা তাদের বের করে দিতে পারিনা। লাইব্রেরির ডিজিটাল গেট নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে। এটি হলে যাদের শিক্ষাবর্ষ শেষ, তারা আর কার্ড ব্যবহার করেও প্রবেশ করতে পারবে না।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে ১৯৭০-১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সকল পত্রিকা ডিজিটাইজড করে রাখা হয়েছে। কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই ধাপে ধাপে গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।