হাসিনাকে প্রত্যর্পণ: দুই দেশের বন্দি বিনিময় চুক্তির অধীনে ভারতের আইনি উপায় কী কী?
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে জানান তিনি।
আজ (২৩ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকায় বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সদরদপ্তরে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা এ কথা জানান।
এরপরে আজ দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য বাংলাদেশ ফেরত চেয়েছে। এটা ভারতকে জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'এ বিষয়ে ভারতকে নোট ভারবাল পাঠানো হয়েছে।'
তৌহিদ হোসেন বলেন, প্রত্যর্পণ চুক্তি মেনে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনতে কোনো বাধা নেই।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট এম হুমায়ূন কবির বলেন, "নোট ভারভাল মানে হলো বাংলাদেশ অফিসিয়ালি (আনুষ্ঠানিকভাবে) ভারতকে অনুরোধ করেছে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য। এখন ভারত হয়ত এর জবাব দিতে পারে।"
তিনি বলেন, "প্রত্যার্পণ চুক্তির কোন ধারায় তাকে ফেরত চাওয়া হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই চিঠিতে উল্লেখ থাকবে। চুক্তির কতগুলো ধারা আছে যা অনুযায়ী তারা তাকে (হাসিনাকে) ফেরত দিতে বাধ্য, আবার কিছু ধারা আছে যেখানে ভারত বাধ্য নয়।"
ঢাকার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে হাসিনাকে ফেরাতে অনুরোধের প্রেক্ষাপটে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে- নয়াদিল্লি যেসব আইনি পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ পাবে, ভারতের গণমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসে তা নিয়ে একটি আইনি বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হয়েছে, যা এখানে তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি সই হয়, যা ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়। এ চুক্তি দুই দেশের মধ্যে পলাতক আসামিদের দ্রুত এবং সহজে বিনিময়ের জন্য করা হয়েছে। ঢাকা এই চুক্তির আওতায় হাসিনাকে বিচারের সম্মুখীন করতে ফেরত চায়। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মামলা হয়েছে। একইসঙ্গে, উল্লেখযোগ্য কিছু দুর্নীতির ঘটনাতেও দেশের একাধিক সংস্থারও তদন্তের সম্মুখীন হাসিনা।
ভারতের ১৯৬২ সনের প্রত্যর্পণ আইন বাংলাদেশ-ভারত বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তির বেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি নথি বা রেফারেন্স হতে পারে। কারণ শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ২০১৩ সালে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিতে ভারতের ১৯৬২ সনের প্রত্যর্পণ আইনের ১২ (২) ধারার প্রাসঙ্গিক অংশগুলোর সম্প্রসারণ রয়েছে।
এই চুক্তি অনুযায়ী, 'প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধের মামলা'য় অভিযুক্ত বা ফেরার আসামি ও বন্দিদের একে অপরের কাছে হস্তান্তর করবে ভারত ও বাংলাদেশ।
চুক্তির ১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারত শুধু সেসব ব্যক্তিদেরই নিজ ভূখণ্ড থেকে প্রত্যর্পণ করবে না যারা প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধ (বাংলাদেশ ও ভারতের আইনের অধীনে কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধ) করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। এটি সেসব ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ করার অভিযোগ আনা হয়েছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের আদালতে দোষী প্রমাণিত না হলেও হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করা যেতে পারে। অপরাধের জন্য তাকে অভিযুক্ত করাই ভারত থেকে তার প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য যথেষ্ট।
এছাড়া, ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তির ১০ (৩) অনুচ্ছেদের অধীনে, বন্দিকে প্রত্যর্পণের জন্য আবেদনকারী রাষ্ট্রের পক্ষে যথাযথ কর্তৃপক্ষের জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করাই যথেষ্ট। যে রাষ্ট্রকে অনুরোধ করা হয়েছে তাকে সংঘটিত অপরাধের প্রমাণ দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। চুক্তিতে ২০১৬ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান রাখা হয়। মূল চুক্তিতে অনুরোধকারী রাষ্ট্রকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ প্রমাণ অনুরোধকৃত রাষ্ট্রকে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে অভিযুক্তদের প্রত্যর্পণকে দ্রুততর ও সহজ করতে ২০১৬ সালের সংশোধনীতে অপরাধের প্রমাণ দেওয়ার বিধান বাদ দেওয়া হয়।
অর্থাৎ, বাংলাদেশ অনুরোধে হাসিনাকে ফেরত দিতে আইনিভাবে বাধ্য ভারত। তবে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না বলে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। যেমন ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কারো অপরাধ যদি রাজনৈতিক প্রকৃতির হয়– তবে তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ খারিজ করতে পারবে অনুরোধ পাওয়া রাষ্ট্র। ১৯৬২ সনের প্রত্যর্পণ আইনের ৩১ (১) ধারায়ও এই রাজনৈতিক ব্যতিক্রমের বিধান রয়েছে। তাহলে ভারত কী এই বিধানের ওপর নির্ভর করে হাসিনাকে ফেরত দেওয়া অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের সুযোগ পাচ্ছে? উত্তর হলো– না, কারণ চুক্তির ৬ (২) অনুচ্ছেদে, এ ধরনের ব্যতিক্রমের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে হত্যা এবং অন্যান্য অপরাধকে বাদ দেওয়া হয়েছে– যেগুলো আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে দেখা হয়, রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে নয়।
চুক্তির ৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যদি অপরাধের জন্য যে দেশে তিনি অবস্থান করছেন সেখানে বিচার করা হয়, তাহলেও তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ খারিজ করা যেতে পারে। তবে এই বিধানটি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না, কারণ ভারতীয় আদালতে তিনি কোনো ধরনের বিচারের সম্মুখীন হবেন– এমনটা দেখানো যাচ্ছে না।
তৃতীয়ৎ চুক্তির অনুচ্ছেদ ৮ (১) (ক) (iii) এ বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণ করা যাবে না যদি 'তিনি অনুরোধকৃত রাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হন যে এসব প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও তাকে প্রত্যর্পণ করা অন্যায্য বা নিপীড়নমূলক হবে' কারণ 'তাঁর বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্যে অভিযোগ আনীত হয়নি।' ভারতের ১৯৬২ সালের প্রত্যর্পণ আইনের ২৯ ধারায় একই নীতি প্রতিফলিত হয়েছে। এই বিধানটি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করতে পারে নয়াদিল্লি।
হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, হাসিনা যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন সেই প্রেক্ষাপট, এবং তার রাজনৈতিক বিরোধীদের দ্বারা বাংলাদেশ পরিচালিত হচ্ছে – একথা জানিয়ে ভারত বলতে পারে, ফেরত পাঠানো হলে তার (হাসিনার) ন্যায়বিচার না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কারণ, রাজনৈতিক বিরোধীরা এই বিচারের মাধ্যমে 'বদলা' চাইছে। বিচার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক শত্রুতা ও অভিসন্ধি কাজ করছে– এমন কথা উল্লেখ করে নয়াদিল্লি দাবি করতে পারে, এই অবস্থায় হাসিনাকে প্রত্যর্পণ হবে অন্যায্য ও পীড়নমূলক।
সঙ্গতকারণেই, আইনি এ যুক্তিতে সন্তুষ্ট হবে না বাংলাদেশের সরকার। কারণ তাঁরা স্বৈরাচারী শাসক হাসিনার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দরকার বলে মনে করেন। কিন্তু, এক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশ প্রত্যর্পণ চুক্তিতে কোনও বাধ্যতামূলক বিচার ব্যবস্থার ব্যবস্থা না থাকায় — উভয়পক্ষই ৮ (১) (ক) (iii) অনুচ্ছেদের আইনি ব্যাখ্যায় অটল থাকতে পারে, যেহেতু কোন পক্ষের ব্যাখ্যা সঠিক তা নির্ধারণে বিরোধ নিষ্পত্তিকারী কোনো সংস্থাও নেই।
ভারতের আরেকটি আইনি উপায় রয়েছে, যা খুবই কঠোর। চুক্তির অনুচ্ছেদ ২১ (৩) এর অধীনে যেকোনো সময় এই চুক্তিটি বাতিলের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ভারতকে। চুক্তি বাতিলের নোটিশ প্রদানের ছয় মাসের মধ্যেই এটি অকার্যকর হয়ে যাবে। চুক্তিতে এমন কিছুই বলা হয়নি, যার আওতায় এটি বাতিলের আগে পাওয়া অনুরোধ বাতিলের পরেও মানতে হবে। হাসিনাকে ভারত কতোটা মূল্যবান মনে করে তার ওপরই নির্ভর করছে– নয়াদিল্লি বাতিলের উপায়টি গ্রহণ করবে কিনা। হাসিনা ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাই নয়াদিল্লি এভাবেও তার পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কিন্তু, চুক্তি বাতিল হলে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্কের তিক্ততা চরম রূপ নেবে– যা আঞ্চলিক, ভূরাজনৈতিক ও কূটনৈতিক দিক থেকে চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এই মুহূর্তে যা ভারতের জন্য আরও সমস্যার সৃষ্টি করবে।
তবে দিনশেষে, আইনি নয়–বরং হাসিনাকে ফেরত পাঠানো না পাঠানোর বিষয়টি হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ভারত যে সিদ্ধান্তই নিক না কেন, সেক্ষেত্রে নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল ও সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরতে আন্তর্জাতিক আইনের ভাষাতেই ব্যাখ্যা, বিবৃতি দেবে।