জনপ্রশাসন সংস্কার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করায় কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার
জনপ্রশাসন সংস্কারকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান মন্তব্য করায় সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগে এক ডজনের বেশি বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
গত ৩০ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডারের একজন কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। আর অন্যান্য ক্যাডারের কমপক্ষে এক ডজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চাকরি বিধি অনুযায়ী প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে ওইসব কর্মকর্তার মন্ত্রণালয়ের সচিবদের চিঠি দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, মৎস ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আটজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশের চিঠির কপি দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড এর হাতে এসেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানা গেছে, আরও কিছু কর্মকর্তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মন্তব্য পর্যালোচনা করা হচ্ছে। সেগুলো আচরণ বিধি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা–২০১৯ লঙ্ঘনের সাথে সম্পর্কিত হলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হবে।
ব্যক্তির কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি সার্বিকভাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা যাতে সরকারি চাকরি বিধি মেনে চলেন, সেজন্য ৩১ ডিসেম্বর বিজ্ঞপ্তি জারি করে কঠোর বার্তা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
সম্প্রতি নেওয়া এক সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আগেই সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভ, ধর্মঘট এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানান মন্তব্য তাদের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদের সমন্বয়ক এম এম রহমান এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, "সরকারি কর্মচারি (আচরণ) বিধিমালা কেউ লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে– এটা স্বাভাবিক। কে কী মন্তব্য করেছে, কেনো করেছে– তা পর্যালোচনার দাবি রাখে।"
তিনি বলেন, "পাশাপাশি এটাও বলতে চাই, জুলাই বিপ্লব হয়েছে প্রধানত বাক স্বাধীনতার জন্য। এখন যদি বাক স্বাধীনতাই না থাকে সেটা এই বিপ্লবের সাথে সাংঘর্ষিক। তবে আমরা আইন অমান্যকারীর পক্ষে নই।"
ক্যাডার অফিসারদের মাঝে মতানৈক্য
অন্তর্বর্তী সরকার জনপ্রশাসন সংস্কারের জন্য গত ৩ অক্টোবর ৮ সদস্যের কমিশন গঠন করে।
গত ১৭ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে এই সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, পরীক্ষা ছাড়া সিভিল সার্ভিসের উপসচিব এবং যুগ্ম সচিব পর্যায়ে কেউ পদোন্নতি পাবেন না বলে সুপারিশ করা হবে। একইসঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য ক্যাডার থেকে ৫০ শতাংশ কর্মকর্তাদের নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
এ সময় তিনি আরও জানান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জুডিশিয়ারি সার্ভিসের মতো আলাদা কমিশনের অধীনে নেওয়ার সুপারিশ করা হতে পারে।
জনপ্রশাসনের বিভিন্ন খাতে বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার সার্ভিস আছে। বর্তমানে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অন্যান্য ক্যাডার থেকে ২৫ শতাংশ কর্মকর্তা পদোন্নতি পান।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সম্ভাব্য সুপারিশ সামনে আসার পর থেকে আন্ত:ক্যাডার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে রূপ নেয়। এমন সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রশাসন ক্যাডারের পদোন্নতির কোটা কমে যাবে বলে তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। একইভাবে প্রশাসনের বাইরে থাকা অন্যান্য ২৫টি ক্যাডারের পক্ষেও কমিশনের সুপারিশকে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করে মেধারভিত্তিতে উপসচিব পদে পদোন্নতির দাবি তোলা হয়েছে। এজন্য ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত 'আন্ত:ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ' নামের একটি সংগঠন কর্মসূচিও পালন করছে।
উভয়পক্ষ তাদের অবস্থান ধরে রাখতে কঠোর অবস্থানও নিয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যামিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন গত ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে এই সংস্কার প্রস্তাবের প্রতিবাদে একটি সভার আয়োজন করে। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তারা জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কমিশন প্রধানের পদত্যাগ চান।
এর আগে, গত ২২ ডিসেম্বর প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা সচিবালয়ে এর প্রতিবাদে শো ডাউন দেখিয়েছেন।
অন্যদিকে, প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থাকা ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন। গত ২৪ ডিসেম্বর এসব ক্যাডারের কর্মকর্তারা একঘণ্টা কর্মবিরতী পালন করেছেন।
২৭ ডিসেম্বর সারাদেশে যার যার কার্যালয়ের সামনে মানববন্ধ করেছেন। আগামী ৪ জানুয়ারি ঢাকাতে কেন্দ্রীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে এই কর্মকর্তাদের সংগঠন।
এছাড়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন উভয় পক্ষের কর্মকর্তারা। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস চালুর দাবি তুলেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এজন্য তারা একটি লোগোও তৈরি করেছেন। অন্যদিকে, প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারাও তাদের দাবিতে যুক্তি তুলে ধরছেন।
কে কী মন্তব্য করে শাস্তি পাচ্ছেন
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের সাবেক আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা সিনিয়র সহকারি সচিব মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান সবুজ সম্প্রতি নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে অযাচিত বক্তব্য পোস্ট করায় তাকে প্রথমে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। এরপর ৩০ ডিসেম্বর চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
এছাড়া মৎস অধিদপ্তরে কর্মরত ৩৭তম বিসিএসের মৎস ক্যাডার জাহিদুল ইসলাম লিখেছেন, উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব পদগুলো সরকারে পদ, কারোও নিজস্ব সম্পত্তি ছিলনা।এটা ভাবা ভুল; একাধিক কাজ নিয়ে না ভেবে একটি নিয়ে পড়ে থাকলেই রাষ্ট্রের বেশি লাভ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহিদুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, তিনি বিষয়টি ৩০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় অবহিত হয়েছেন। এরবাইরে এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য মোবাইল ফোনে তিনি করতে চাননি।
এদিকে, পঞ্চগড় জেলার আটোয়ারি উপজেলার উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোঃ জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন কমিটিতে ইউএনও এবং এসি ল্যান্ডের ভূমিকার সমালোচনা করেন এবং অন্যদেরকে তাদের সহায়তা না করার পরামর্শ দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীর আলমের কাছে মোবাইল ফোনে জানতে চাইলে তিনি টিবিএসকে বলেন, "ওই মন্তব্যগুলো আমার করা নয়। আমার ফেইসবুক আইডি ক্লোন করে করা হয়েছে। জনপ্রশাসন থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেটি এখনও আমি জানি না।"
এই দুজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ২৩ ও ২৯ ডিসেম্বর মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদকে আলাদা চিঠি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
নেত্রকোনার মদনের সরকারি হাজী আব্দুল আজিজ খান ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক আনোয়ার মিলন ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, 'খুব জানতে ইচ্ছে করছে.... জামদানী পড়ে ভাইবা দিয়েছিল কিনা..? এতে অনেকেই ০৩ মিনিটে বোর্ডকে অসম্ভব রকমের সন্তুষ্ট করার মোহনীয় ক্ষমতা রাখে…'
সিলেটের জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রভাষক তানভীর খান লিখেছেন, 'সরকার যদি হয় রাষ্ট্রের মস্তিষ্ক আর শাসন বিভাগ যদি হৃদপিন্ড তাহলে আমলারা হবে রাষ্ট্রের শিশ্ন। এটা দিয়ে চাইলে নতুন প্রজন্ম গঠন সম্ভব, চাইলে জনগণকে ধর্ষণও সম্ভব তবে, কোনো কিছুতেই তার সম্ভোগের ক্ষতি/কমতি পড়বেনা।'
৩৮তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের প্রভাষক এজেডএস এম রফিকুল জমাদার লিখেছেন, 'স্বৈরাচার পতন পরবর্তী বিপ্লবী সরকার আসা মানে স্বৈরাচারের দোসরদের অবস্থা খারাপ। হাজার হাজার আমলার চাকরি চলে যাবে, হাজার হাজার পুলিশের চাকরি চলে যাবে, আর্মিতে শতশত মানুষ চাকরি হারাবে, সেই পলিটিকাল পার্টিতে হাজার হাজার লোককে জেলে ভরা হবে। যেখানে স্বৈরাচারে চিহ্ন থাকবে তা উপড়ে ফেলা হবে। এটাই নিয়ম…. কিন্তু আমাদের বিপ্লব পরবর্তী অতিরিক্ত সুশীল সরকার স্বৈরাচার আমলের ১০০ জনকেও চাকুরিচ্যুত করে নাই, ১০০০ জনকেও গ্রেফতার করে নাই। সমন্বয়করা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ইউনূস সাহেবকে বসাইছে ঠিক আছে তার টিমমেট হিসেবে কিছু বিপ্লবী মানুষ দিতো? দিছে সবগুলো নপুংসককে। সব বাটপার এবং অযোগ্য লোক দিয়ে উপদেষ্টামণ্ডল বানাইছে, যারা চারমাসেও দেশে কোনো কন্ট্রোল আনতে পারে নাই। এই সরকার নিজে তো ডুববে ডুববেই, পুরো দেশ নিয়ে ডুববে।'
৩৮তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের আরেক প্রভাষক অসীম চন্দ্র সরকার লিখেছেন, 'নির্দিষ্ট চাকুরি/টাকাপয়সা হলে পরে আপনি যেমন ভাব মারাইতে গিয়ে বাকিদের যা-তা ভাবেন, হেতারাও আপনারে তলে তলে শুয়ারের বাইচ্চাই ভাবে। মানুষ/শুয়ার হবার চয়েস নিতান্তই ব্যক্তিগত!'
এ ধরনের তির্যক মন্তব্য করে কমপক্ষে ২০০ শব্দের স্টাটাস দিয়েছেন বরিশালের চাখারের সরকারি ফজলুল হক কলেজের সহকারি অধ্যাপক (দর্শন) শাহাদাৎ কায়সার।
শিক্ষা ক্যাডারের এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে ফেসবুকে অযাচিত মন্তব্য করায় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়ে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জুনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মোঃ এমদাদুল হক রাসেলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জামিলা শবনম স্বাক্ষরিত চিঠিগুলোতে বলা হয়েছে, এসব কর্মকর্তার মন্তব্যে মন্ত্রণালয়/দপ্তরে কর্মরত অন্যান্য সিনিয়র/জুনিয়র/সতীর্থ কর্মকর্তাদের মনে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে এবং আন্ত:ক্যাডার সমন্বয়হীনতা সৃষ্টি করতে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের বক্তব্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার নির্দেশিকা, ২০১৯ এর ৭ এবং ১০ ধারানুযায়ী পরিহারযোগ্য বিষয়াদির আওতাভুক্ত।
ফলে প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ ধরনের বক্তব্য প্রদান আচরণ বিধি লঙ্ঘনের শামিল এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।