শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ, ভারতের কৌশল কী হবে?
২০২৪ সালের ৫ আগস্টে গণ-অভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য, গত ২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভারতকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে।
ওই দিন ঢাকার পক্ষ থেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে 'নোট ভারবাল' (কূটনৈতিক নোট) পাঠানো হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, 'ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ন্যায্যতা, সমতা এবং মর্যাদার ভিত্তিতে হওয়া উচিত'। একই সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ঢাকা সফরে এসে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের আশা ব্যক্ত করেন।
চলমান মামলায় আদালতে আত্মসমর্পণ না করায় 'পলাতক' ঘোষণা করা হয়েছে শেখ হাসিনাকে। ছাত্র আন্দোলনে দমন-পীড়ন ও হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গত ১৩ আগস্ট মামলা দায়ের হয়। তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার জন্য দায়ী করা হয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে এই মামলার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সংগ্রহে জোর দেওয়া হচ্ছে, যাতে অভিযোগপত্রে যথেষ্ট শক্তিশালী তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করা যায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনা ও আরও ৪৫ জন, যাদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, উপদেষ্টা, সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তারা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
পরবর্তী সময়ে ১৮ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল তদন্ত কর্তৃপক্ষকে ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে তদন্ত শেষ করার জন্য এক মাসের সময়সীমা দেয়। শিগগিরই অভিযোগপত্র দাখিলের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে বিচার
কমন ল' বিচারব্যবস্থায় কোনো অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে বিচার শুরু করা যায় না। বিচার শুরু করতে অভিযুক্তকে আদালতে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে হয় বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে অংশগ্রহণ করতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্তের আইনজীবী উপস্থিত থাকলে তা অভিযুক্তের প্রতিনিধিত্ব হিসেবে ধরা হতে পারে, যদিও এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
বাংলাদেশের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৯-বি ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি অনুপস্থিত থাকলেও তার বিচার চালানো সম্ভব। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এর উদাহরণ রয়েছে। ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রি ট্রায়াল চেম্বার থ্রি-এর মাধ্যমে অভিযুক্ত জোসেফ কোনির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি তার অনুপস্থিতিতেই করার সিদ্ধান্ত নেয়। উগান্ডায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত কোনি গত ১৯ বছর ধরে পলাতক।
বাংলাদেশ শেখ হাসিনার বিচার প্রক্রিয়ার জন্য যথোপযুক্ত স্থান হতে পারে, কারণ অভিযুক্ত অপরাধের ঘটনাস্থল, সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং ভুক্তভোগীরা বাংলাদেশেই রয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ভারতকে কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ জানিয়েছে। তবে ভারত এ বিষয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি।
আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইনে রাষ্ট্রগুলোর ওপর গুরুতর আন্তর্জাতিক অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযুক্তকে 'প্রত্যর্পণ বা বিচার' করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও ভারত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতায় আবদ্ধ নয়।
প্রত্যর্পণ ঠেকাতে ভারতের সম্ভাব্য কৌশল
ভারত শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগিত অপরাধগুলোতে কোনো ধরনের সহায়তা বা সহযোগিতা করেনি, এবং তার প্রতি কোনো অপরাধের প্ররোচনাও দেয়নি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৩ সালে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি সই হয়, যা ২০১৬ সালে সংশোধিত হয়। এ চুক্তি দুই দেশের মধ্যে পলাতক আসামিদের দ্রুত এবং সহজে বিনিময়ের জন্য করা হয়েছে। ঢাকা এই চুক্তির আওতায় হাসিনাকে বিচারের সম্মুখীন করতে ফেরত চায়।
এছাড়া ভারতীয় প্রত্যর্পণ আইন ১৯৬২ অনুযায়ী দেশটি নিজ নাগরিক ও বিদেশি নাগরিকদের প্রত্যর্পণ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামো অনুসরণ করে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রত্যর্পণের আবেদনকারী এবং ভারত হচ্ছে প্রত্যর্পণপ্রাপ্ত রাষ্ট্র।
প্রত্যর্পণ ঠেকাতে ভারত দুইটি কৌশল অবলম্বন করতে পারে। প্রথমত, ভারত দাবি করতে পারে যে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক অপরাধ করেছেন, যা প্রত্যর্পণের আবেদন খারিজ করার বৈধ কারণ হতে পারে। তবে এই যুক্তিটি খুবই দুর্বল, কারণ প্রাথমিকভাবে শেখ হাসিনার কর্মকাণ্ডকে রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির অনেক আগেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তার সরকারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সহিংসতা, নির্যাতন, গুম, নিপীড়ন এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিল। সুতরাং, তার বিরুদ্ধে এসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে কিনা, তা কেবল একটি নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমেই সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব।
ভারত দ্বিতীয় কৌশল হিসেবে 'নন-ইনকোয়ারি' নীতির ওপর নির্ভর করতে পারে। এ নীতিতে বলা হয়েছে, প্রত্যর্পণের বিষয়টি পুরোপুরি নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্ত, যেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি স্থানীয় আদালতের হস্তক্ষেপ চাইতে পারেন না। যদিও এই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা বর্তমানে কমেছে। তবু শেখ হাসিনা, ভারতীয় নাগরিক না হলেও, সংবিধানের ২০ এবং ২১ অনুচ্ছেদের অধীনে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রাখেন।
১৯৯৬ সালে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন বনাম অরুণাচল প্রদেশ ও অন্যান্য মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করে যে, সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত 'ব্যক্তি' শব্দটি শুধু ভারতীয় নাগরিকদের জন্য নয়, বরং সকলের জন্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে নির্যাতন এবং কারাগারের অবস্থার অতীত রেকর্ড বিবেচনা করে আদালত যুক্তিযুক্তভাবে শেখ হাসিনাকে সুরক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং প্রত্যর্পণ থেকে বিরত রাখতে পারে।
তবে এর বিকল্প সমাধানেও চাইলে হাঁটতে পারে ভারত। ভারত সরকার শেখ হাসিনার জন্য ভারতে গৃহবন্দির ব্যবস্থা করতে পারে, যেখানে তিনি বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে আছেন, তা অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় তিনি ভার্চুয়াল মাধ্যমে বাংলাদেশের আদালতে তার বিচার কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারেন, এবং তার পছন্দের একজন আইনজীবী আদালতে শারীরিকভাবে উপস্থিত থাকতে পারেন।
ভারত বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করতে পারে যে, তারা তদন্ত এবং প্রমাণ সংগ্রহে পুরোপুরি সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ পাবে, তবে পূর্বানুমতির ভিত্তিতে। যদি রায় তার বিরুদ্ধে যায়, তবে একটি শাস্তি চুক্তির ভিত্তিতে তিনি ভারতের মাটিতেই তার সাজা ভোগ করতে পারেন।
এই পদক্ষেপ ভারতের সদিচ্ছার প্রমাণ প্রদান করে এবং জাতিসংঘ সনদের ২(৪) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে। একই সঙ্গে এটি অভিযুক্তের সুরক্ষা ও মানবাধিকারের ঝুঁকি দূর করবে।
শেখ হাসিনা এখন ক্ষমতায় নেই, এবং তার বার্ধক্য ও শারীরিক দুর্বলতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাকে কোনো বাড়তি কষ্ট দেওয়া ন্যায্য হবে না। তার মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। যুক্তিসংগত এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একটি দৃষ্টিভঙ্গি এ সমস্যার সমাধানে সহায়ক হতে পারে। আবেগপ্রবণ ও বিতর্কিত তর্ক-বিতর্ক দীর্ঘমেয়াদে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশকে বুঝতে হবে যে, শেখ হাসিনার বিচার প্রয়োজন, তবে তাকে প্রতিহিংসার শিকার হতে দেওয়া উচিত নয়। অন্যদিকে, ভারতের উচিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর জন্য এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা, যেখানে তারা সফলভাবে তার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এভাবে একটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভারত ও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সহযোগিতামূলক মনোভাবের উদাহরণ স্থাপন করতে পারবে।
বিকল্প হিসেবে আইসিসি
বাংলাদেশ রোম সংবিধির ১১১তম সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-এ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। রোম সংবিধির ৫, ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এই মামলাটি আইসিসি-র আওতায় আসার জন্য কয়েকটি শর্ত পূরণ করতে হয়। এটি মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গুরুতর, অভিযুক্ত একজন সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিক, অপরাধটি বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে এবং এটি ২০০২ সালের পরের ঘটনা—এসব শর্ত পূরণ হলেই মামলাটি আইসিসি-তে নেওয়া সম্ভব।
আইসিসি জাতীয় বিচারব্যবস্থার সম্পূরক হিসেবে কাজ করে, বিকল্প নয়। যেহেতু বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে এই বিচার শুরু করেছে, তাই আইসিসি হস্তক্ষেপ করার কোনো কারণ খুঁজে পাবে না।
তবে, রোম সংবিধির ৫৩ এবং ১৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যদি প্রমাণিত হয় যে অভিযুক্তের অধিকার হুমকির মুখে রয়েছে বা বিচার যথাযথ ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হচ্ছে না, তাহলে আইসিসি-র প্রসিকিউটর কার্যালয় প্রাথমিক তদন্ত শুরু করতে পারে।
শেখ হাসিনার অধিকার আইসিসি-র ২১(৩) অনুচ্ছেদ এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার চুক্তির ১৪ অনুচ্ছেদের অধীনে সুরক্ষিত। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশ চাইলে রোম সংবিধির ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মামলাটি আইসিসি-তে স্থানান্তর করতে পারে। এছাড়া, আইসিসি-র প্রসিকিউটর কার্যালয় ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নিজ উদ্যোগে প্রাথমিক তদন্ত শুরু করতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনা স্বেচ্ছায় আইসিসিতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে না এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে তার বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হবে।
অনুবাদ: সাকাব নাহিয়ান শ্রাবন