সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তথ্য পেতে দীর্ঘসূত্রতা: তদন্ত আটকে আছে রিজার্ভ চুরিসহ ১০ মামলার
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা জোবায়ের বিন হুদা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা করেন।
পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) ফিনান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট তখন থেকে দেশের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর এই আর্থিক অপরাধের তদন্ত করছে।
তবে মামলা দায়েরের সাড়ে আট বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত। প্রতিবেদন জমা দিতে ৮০ বারের মতো সময় নিয়েছে তদন্ত সংস্থা। আগমী ৪ ফেব্রুয়ারি ফের মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মামলা তদন্ত কার্যক্রম শেষ পর্যায়ে তবে; চীন এবং শ্রীলঙ্কায় মিউচুয়াল লিগাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর)-এর মাধ্যমে চাওয়া তথ্য এখনো না পাওয়ায় তারা চার্জশিট জমা দিতে পারছেন না।
এমএলএআর হল একটি আনুষ্ঠানিক অনুরোধ, একাধিক দেশের মধ্যে কোনো ফৌজদারি তদন্ত বা বিচারের সহায়তার জন্য করা হয়ে থাকে।
সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মামলাসহ অন্তত ১০টি চাঞ্চল্যকর অর্থপাচার মামলার তদন্ত আটকে আছে কেবল সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তথ্য না পাওয়ার কারণে।
এসব মামলার মধ্যে রয়েছে, ক্যাসিনো কাণ্ডে আলোচিত সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে ৯৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা বিদেশে পাচার, এমপি কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে ৩৮ কোটি ২৬ লাখ ৯৬ হাজার ৫৬৬ টাকা, যুবলীগ নেতা সম্রাট ও আরমানের বিরুদ্ধে ১৯৫ কোটি টাকা, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে ৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা, আব্দুর রহমান রাজুর বিরুদ্ধে ৩০ কোটি তানজানিয়ান সিলিং পাচার, সাবেক কমিশনার ও যুবলীগ নেতা একেএম মমিনুল হক সাঈদের বিরুদ্ধে ৪৬ লাখ ৪৯ হাজার ১৬০ টাকা বিদেশে পাচার এবং ফারইস্ট স্টক অ্যান্ড বন্ডস এর চেয়ারম্যান এমএ খালেকের বিরুদ্ধে ১১৬ কোটি টাকা পাচারের মামলা অন্যতম।
টিবিএস'র পক্ষ থেকে অন্তত ৬টি মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের তদন্ত কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে এমএলএআর'র মাধ্যমে চাওয়া তথ্য না পাওয়ায় তারা চার্জশিট জমা দিতে পারছেন না।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল ইয়াসিন টিবিএসকে বলেন, মামলার চার্জশিট জমার দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে তথ্য পাওয়া জরুরি। ৫টি দেশে তথ্য চেয়ে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এখনও দুটি দেশ থেকে তথ্য না মেলায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারছে না তদন্ত সংস্থা।
তিনি বলেন, "আমরা চায়না, আমেরিকা, জাপান, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কায় এমএলএআর পাঠিয়েছিলাম। এরমধ্যে শ্রীলঙ্কা ও চায়না থেকে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে তদন্তের জন্য এই দুইটি দেশের তথ্য পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ।"
"আমরা তথ্যের জন্য বিগত চার বছর ধরে কয়েক দফা এমএলএআর পাঠিয়েছি এই দুই দেশে, কিন্তু কোনো রিপ্লাই আসেনি। তথ্য না পেলে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে না," যোগ করেন তিনি।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউইয়র্কের বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অজ্ঞাত হ্যাকাররা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুইফট পেমেন্ট সিস্টেমে জালিয়াতির মাধ্যমে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে।
চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে ম্যানিলার রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি) এর চারটি অ্যাকাউন্টে ৮১ মিলিয়ন ডলার এবং শ্রীলঙ্কার একটি ব্যাংকে আরও ২০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করা হয়।
তবে, হ্যাকারদের দ্বারা বানানে ভুল হওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কায় ২০ মিলিয়ন ডলার স্থানান্তর শেষ মুহূর্তে আটকে যায়; শ্রীলঙ্কা থেকে ওই অর্থ ফেরত পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পরবর্তীতে, ফিলিপাইন থেকে আরও প্রায় ১৫ মিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দায়িত্বে অবহেলার জন্য আরসিবিসি থেকে জরিমানা হিসেবে এ অর্থ আদায় করা হয়।
তবে, প্রায় ৬৬ মিলিয়ন ডলার এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "এমএলএআর মাধ্যমে তথ্য চাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ঘাটতি রয়েছে। যথাযথ পক্রিয়া অনুসরণ করে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট এমএলএএফ পাঠানো হয় না। যার কারণে সংশ্লিষ্ট দেশ এমএলএআর এর রিপ্লাই করেন না।"
তিনি বলেন, "তথ্য চেয়ে এমএলএআর পাঠানোর জন্য দেশের আদালত থেকে দেওয়া নির্দেশনা যুক্ত করে সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে যথাযথ ঠিকানায় এমএলএআর পাঠাতে হবে। অন্যথায় রিপ্লাই আসবে না।"
"সম্প্রতি আমাদের দেশ থেকে একটি এমএলএআর বিট্রিশ ট্রেড মিনিস্ট্রিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু এই মিনিস্ট্রির সঙ্গে এমএলএআর এর কোনো সম্পর্ক নেই। এ ধরনের ঘাটতি আমাদের আছে। আদালতের নির্দেশনা যুক্ত করে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণের মাধ্যমে এমএলএআর পাঠানো হয়েছে কি-না তার ওপর নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট দেশ এমএলএআর রিপ্লাই করতে রাজি হবে কি-না," বলেন তিনি।
ইফতেখারুজ্জামান আরও জানান, "আবার অনেক সময় পাচারকৃত অর্থ সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হওয়ায় সেই দেশের সরকারও ওই টাকা ফেরতের বিষয়ে আগ্রহ দেখায় না। কোনো দেশ চাইবে না তাদের অর্থনীতির ক্ষতি করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দিতে।"
পাপুল এবং সম্রাটের বিরুদ্ধে মামলার তদন্তকারী ইন্সপেক্টর মেহেদী মাকসুদ টিবিএসকে বলেন, উভয় তদন্তই প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু কুয়েত এবং মালয়েশিয়া থেকে তথ্যের অপেক্ষায় চার্জশিট দাখিল করা হয়নি।
তিনি বলেন, "আমরা ২০২০ সালে মালয়েশিয়ায় এবং ২০২১ সালে কুয়েতে সম্রাটের সম্পদের তথ্যের বিষয়ে জানতে অনুরোধ জানাই। তবে, এখনও আমরা কোনো দেশে থেকেই রিপ্লাই পাইনি।"
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান মতিউর রহমান শেখ টিবিএসকে বলেন, "তারা বাংলাদেশ ব্যাংককের রিজার্ভ চুরির মামলটি নিয়ে গুরুত্বসহারের কাজ করছে। আমরা যেহেতু এমএলএআর দিয়ে তথ্য পাচ্ছি না– সেক্ষেত্রে আমরা বিকল্প হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাম্বাসির মাধ্যমে তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করবো।"
অন্য মামলাগুলোর বিষয়ে তিনি, "এমএলএআর হচ্ছে মামলা তদন্তের একটি অংশ। এর বাইরেও আমাদের তদন্ত কাজ করতে হয়। সেটি অব্যাহত রয়েছে। সাধারণত অর্থপাচার মামলায় তদন্ত শেষ হতে অন্য মামলার তুলনায় সময় লাগে বেশি। তথ্য পাওয়ার জন্য আপাতত এমএলএআর এর বিকল্প আমরা কিছু ভাবছি না।"