শিশু আয়ানের মৃত্যু: ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ তদন্ত কমিটির
রাজধানীর বাড্ডার সাতারকুলের ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় দুই চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে আয়ানের মা-বাবাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এছাড়াও, সারাদেশে অনুমোদনহীন সব হাসপাতাল, ক্লিনিক বন্ধের সুপারিশ করেছে কমিটি।
রোববার (২৬ জানুয়ারি) প্রতিবেদনটি শুনানির জন্য বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চে উপস্থাপন করা হয়। প্রতিবেদনের ওপর আংশিক শুনানি শেষে আগামী ২৮ জানুয়ারি এ বিষয়ে পরবর্র্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'তদন্ত কমিটির সদস্যরা মনে করেন শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দায়ী। কেননা এই মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি একটি নির্মাণাধীন প্রতিষ্ঠান। এ মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন না থাকায় এটি বৈধভাবে চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারে না।'
বলা হয়, 'কমিটি মনে করে সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করার পরিবেশ যেমন ছিল না, তেমনি অস্ত্রোপচার পরবর্তী জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যবস্থাও ছিল না।'
আরও বলা হয়, 'এছাড়াও গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে আয়ানের বাবা ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে ডাক্তার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ব্যবহার ছিল রুঢ়। সবশেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাঁচ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকা বিল পরিশোধ করে আয়ানের মৃতদেহ নিয়ে যেতে বলাটা ছিল অমানবিক।'
হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত এটি দ্বিতীয় তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন।
রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, 'রোববার ওই প্রতিবেদন শুনানির জন্য উপস্থান করা হলে, আদালত বলেন এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা নিজেরাও চিকিৎসা অবহেলার শিকার হয়েছি। তাই ২৮ জানুয়ারি এ বিষয়ে গুরুত্বসহশুনানি করা হবে।'
এর আগে হাইকোর্টের নির্দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করলে গত বছরের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট সেই প্রতিবেদনকে 'আইওয়াশ (লোক দেখানো) ও হাস্যকর'- বলে মন্তব্য করেন।
এরপর গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম মাকসুদুল আলমকে চেয়ারম্যান করে নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করে দেন হাইকোর্ট।
শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের অবহেলা আছে আছে কি-না, তার মৃত্যুর ঘটনায় কারা দায়ী এ কমিটি তা খুঁজে বের করতে বলা হয়।
নতুন তদন্ত কমিটির সুপারিশ:
তদন্ত কমিটি এই হাসপাতালের বিষয়ে ৫টি সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- সাতারকুলে অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ক্ষতিপূরণ প্রদান করা উচিত; ক্ষতিপূরণের একটি অংশ আয়ানের পিতামাতাকে প্রদান করা এবং অন্য অংশ দিয়ে দুস্থ শিশু ও কিশোর/কিশোরীদের জন্য একটি হাসপাতাল নির্মাণ করার জন্য কমিটির সদস্যরা সুপারিশ করছেন; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া চিকিৎসা কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং শিশু আয়ানের মৃত্যুর জন্য ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক; ডাক্তার তাসনুভা মাহজাবীন ও অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সৈয়দ সাব্বির আহম্মদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলো।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য কয়েকটি সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি।
সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের সব মানুষের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যমান আইনগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিদ্যমান আইনের সংস্কার ও পরিমার্জন করার সুপারিশ করা হলো; বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় রেফারেল পদ্ধতির মাধ্যমে নিচ থেকে উচ্চ পর্যায়ের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের কাছে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করা হচ্ছে; অপরিকল্পিত, মানহীন (ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ) বন্ধ করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে; এন্টিবায়োটিকের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুন্নতে খৎনার জন্য অজ্ঞান করা শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি নতুন কমিটি গঠন করে দিয়ে হাইকোর্ট বলেন, '২৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিটির দাখিল করা রিপোর্ট আমাদের মনঃপুত হয়নি। আমরা পাঁচ সদস্যের নতুন কমিটি করে দিচ্ছি।'
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
কমিটিতে তিনজন চিকিৎসক, দুইজন সিভিল সোসাইটির ব্যক্তি ও একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপককে রাখা হয়। সোহওয়ার্দী হাসপাতালের অধ্যাপক ডাক্তার এ বি এম মাকসুদুল আলমকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়।
শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় চিকিৎসকদের অবহেলা আছে আছে কি-না, তার মৃত্যুর ঘটনায় কারা দায়ী এ কমিটি তা খুঁজে বের করবে।
পাঁচ বছর বয়সী আয়ানকে খৎনা করানোর জন্য ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার সাতারকুল এলাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালে নিয়ে গিয়েছিল তার পরিবার। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
গত বছরের ৭ জানুয়ারি সেখানেই মৃত্যু হয় শিশুটির। আয়ানের বাবা শামীম আহামেদ পরে বাড্ডা থানায় মামলা করেন।
ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট সাইদ সাব্বির আহমেদ, সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক তাসনুভা মাহজাবিন, অজ্ঞাতনামা পরিচালকসহ কয়েকজনকে আসামি করা হয় সেখানে।
আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে গত ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এ বি এম শাহজাহান আকন্দ মাসুম।