আরাকান সংকটে অচল টেকনাফ স্থলবন্দর: আমদানি-রপ্তানি বিপর্যস্ত, রাজস্ব আয় প্রায় শূন্যের কোঠায়
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/02/p3_teknaf-land-port-paralysed.jpg)
মিয়ানমারে জাতিগত সংঘাত এবং আরাকান আর্মিদের হাতে বাংলাদেশি আমদানিকারকের পণ্যবাহী জাহাজ আটকে রাখার ঘটনায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে টেকনাফ স্থলবন্দরে। যে বন্দর দিয়ে দৈনিক ছোট বড় ২০টির বেশি জাহাজ আসা-যাওয়া করতো, এখন সপ্তাহে এক থেকে দুটির বেশি জাহাজ আসছে না।
এর প্রভাবে প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে এই বন্দরের রাজস্ব আয়। স্বভাবিক সময়ে যেখানে প্রতিদিন ৩ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় হতো, এখন শুল্ক কর্মকর্তারা অলস সময় কাটাচ্ছেন।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে মিয়ানমারে জান্তা সরকারের সাথে বিদ্রোহী আরকান আর্মিদের সংঘাত শুরু হলে ক্রমশ কমতে থাকে এই বন্দরের আমাদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। সবশেষ মংডু শহর আরাকান আর্মি দখলে নিলে এই পথে পণ্যবাহী জাহাজ আটকে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। আটককৃত তিনটি জাহাজের মধ্যে ২টি জাহাজ ছেড়ে আগে ছেড়ে দিলেও একটি জাহাজ ছাড়া হয়েছে গতকাল (১ ফেব্রুয়ারি)। মূলত এ ঘটনার পর থেকে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আমদানি পণ্য পরিবহন প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
টেকনাফ স্থলবন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্টের ব্যবস্থাপক এ এইচ এম আনোয়ার হোসেন টিবিএসকে বলেন, "টেকনাফ স্থলবন্দরে পণ্য ওঠা-নামাসহ কর্মকর্তা পর্যায়ে কর্মরত আছেন প্রায় ৯০ জন কর্মকর্তা। জাহাজ এবং পণ্য হ্যান্ডলিং করে এই বন্দর দৈনিক ৫ লাখ থেকে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করতো। এখন সেটি নেমে এসেছে ৪০ হাজার টাকা থেকে ৫০ হাজার টাকায়।"
তিনি বলেন, "স্বাভাবিক সময়ে পণ্যবাহী ট্রলার, লাইটার জাহাজসহ পণ্য নিয়ে ১৫ থেকে ২০টি নৌযান আসতো। এখন এই সংখ্যা প্রতি সপ্তাহে একটি বা দুটিতে নেমে এসেছে। সবশেষ ২৮ জানুয়ারি ৬৭১ বস্তা মাশকলাই নিয়ে একটি ট্রলার মিয়ানমার থেকে টেকনাফে আসে।"
১৬ জানুয়ারি আরাকান আর্মিদের হাতে আটক জাহাজের বিষয়ে এ এইচ এম আনোয়ার হোসেন বলেন, "ওই জাহাজে ৩০ হাজার বস্তা মালামাল ছিল। প্রতি বস্তা মালামালে ৫০ কেজি হিসেবে ১৫ হাজার মেট্রিক টন পণ্য ছিল। এই বন্দরে চলাচলকারী এটি একটি বড় জাহাজ।"
এই জাহাজটি আটকে রাখার কারণ হিসেবে আমদানিকারকদের বরাত দিয়ে বন্দরের এই কর্মকর্তার জানান, "আমদানিকারকদের কাছে থেকে জেনেছি, জাহাজটির মালিক জান্তা সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। জাহাজটি মংডু থেকে পণ্য নিয়ে আসছিল। যেহেতু মংডু শহর এখন আরাকার আর্মিদের দখলে, তাই জাহাজটিকে পণ্য চেক করার নামে আটকে দেওয়া হয়। প্রতিটি বস্তা তারা চেক করেছে।"
এর আগে, গত ২০ জানুয়ারি মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন থেকে পণ্য নিয়ে টেকনাফ স্থল বন্দরে আসার পথে মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মিদের হাতে আটক দুটি জাহাজ ছাড়া পেয়ে টেকনাফ স্থলবন্দরে পৌঁছায়। জাহাজ দুটিতে প্রায় ১,৫০০ মেট্রিকটন পণ্য ছিল। গত ১৬ জানুয়ারি টেকনাফ স্থলবন্দরে আসার পথে জাহাজগুলো আটক করে আরাকান আর্মি।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক বাহাদুর বলেন, আটক করা জাহাজে শুটকি, কফি, সুপারি,কসমেটিকসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য ছিল। ওই জাহাজে সিআইপি ফরুক নামে একজনের ৬০ মেট্রিক টনেরও বেশি শুটকি রয়েছে। এছাড়া, জাহাজে থাকা ২৫০ টনের বেশি শুটকি জাহাজেই নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হয়।
"আমাদের একজন আমদানিকরকের ৭০ টনের বেশি আচার আছে। এসব আচার কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হওয়ার কথা রয়েছে। পণ্যগুলো এখন কী অবস্থায় আছে, আমরা নিশ্চিত নই।"
তিনি বলেন, "মায়ানমার থেকে যেসব জাহাজ এবং বোট টেকনাফে আসে, সেগুলো আরাকান রাজ্য হয়ে আসে। ওই এলাকা আরাকান আর্মির দখলে। এই রুট এড়াতে টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপ, ঘোলার চর হয়ে ২০ কিলোমিটার নৌ পথে নতুন রুট করা যায়। তবে এই পথে দুই কিলোমিটার এলাকায় নাব্যতা সংকট রয়েছে। সেখানে ড্রেজিং করা গেলে নতুন রুটে পণ্য পরিবহন করা সম্ভব হবে।"
ক্রমশ কমছে আমদানি-রপ্তানি ও রাজস্ব আয়
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এক বছর আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। ২০২৪ সালের শুরুতে মিয়ানমারে যুদ্ধ শুরু হলে পণ্য আসার পরিমাণ কমতে থাকে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন অন্তত ১০টি জাহাজ এবং ট্রলার বন্দর জেটিতে খালাসের অপেক্ষায় থাকতো। এখন পুরো জেটি ফাঁকা। পণ্য ছাড়ে নিয়োজিত ছিল ২৫ থেকে ৩০টি সিএন্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠান। এখন ১০ শতাংশ কাজও হচ্ছে না।
টেকনাফ স্থলবন্দর এবং শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয় ৬৪০ কোটি টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয় ৬৮ হাজার মেট্রিক টন। এতে রাজস্ব আদায় হয় ৪০৭ কোটি টাকা। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) পণ্য আমাদনি হয় ১১ হাজার মেট্রিক টন। রাজস্ব আদায় হয় মাত্র ৮৭ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৪৭ হাজার মেট্রিক টন পণ্য আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২৫৭ কোটি টাকা।
টেকনাফ স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা বি এম আবদুল্লাহ আল মাসুম টিবিএসকে বলেন, "স্বাভাবিক সময়ে এই স্থল বন্দর দিয়ে দৈনিক প্রায় ৩ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতো। এখন সেটি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।"