ফুলেরা এবার হাসবে: সিলেটে বিনা খরচে ঠোঁট ও তালু কাটার অস্ত্রোপচার আশা দেখাচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/big_3/public/images/2025/02/04/sylhet_cleft_lip_surgery.jpg)
হাসপাতালের বিছানায় বসে আর্ট পেপারে ফুলের ছবি আঁকছিলো আদিবা আমিন মারিয়া। তার বয়স মাত্র ৭। ফুলের মতো ছোট্ট শিশু। ঠোঁট ও তালুতে সেলাই বসানো। ফলে কথা বলতে পারছে না সে; ঠিক যেমন কথা বলছে না আর্ট পেপারে আদিবার আঁকা ফুল।
সে তো জানা কথাই- ফুলেরা কথা বলে না। কিন্তু ফুলের মতো মিষ্টি মেয়ে আদিবা শীঘ্রই সুন্দর করে কথা বলতে পারবে।
মাত্রই কদিন আগে (২০ জানুয়ারি) তার কাটা ঠোঁট ও তালুতে অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাও বিদেশের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের তত্ত্বাবধানে এবং বিনা খরচে।
সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আদিবার বিছানার পাশেই বসে ছিলেন তার বাবা রুহুল আমিন। বসে বসে খুশি মনে মেয়ের ছবি আঁকা দেখছিলেন।
রুহুল আমিন বলেন, "জন্ম থেকেই আমার মেয়ের ঠোঁট ও তালু কাটা। তাই ভালো করে কথা বলতে পারতো না। হাসতে পারতো না। অস্ত্রোপচারের পর আমার ঘরের এই ফুলটি স্বাভাবিকভাবে হাসবে-কথা বলবে, এতে আমি খুবই খুশি।"
সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরের দরিদ্র শ্রমজীবী রুহুল আমিনের সাধ্য ছিল না এতো বিপুল ব্যয়ের এই অস্ত্রোপচার করার। তার এই অসাধ্যকে সাধন করে দিয়েছে বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ, সিলেট ওইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রোটারি ক্লাব অব জালালাবাদ এবং মিশন রোটাপ্লাস্ট।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2025/02/04/img-20250202-wa0012.jpg)
শেভরনের অর্থায়নে অন্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলো সিলেটে ঠোঁট কাটা, তালু কাটা রোগীদের এই অস্ত্রোপচারের আয়োজন করে।
কেবল আদিবা নয়, এবারের মিশনে অস্ত্রোপচার করা হয় ৬৬ জন রোগীর। যাদের বেশিরভাগই শিশু ও দরিদ্র পরিবারের। চলতি বছর নিয়ে অষ্টমবারের মতো এই আয়োজন করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জের বদরুন্নেছার স্বামী দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তার মেয়ে মুনতাহার (৬) জন্ম থেকেই ঠোঁট ও তালু কাটা। পক্ষাজ্ঞাতগ্রস্ত স্বামীকে নিয়ে সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হয় বদরুন্নেছাকে। মেয়ের অস্ত্রোপচার করানো তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। শেভরনের অর্থায়নের এই উদ্যোগের কারণে মেয়ে মুনতাহার অপারেশন করাতে পেরেছেন বদরুন্নেছা।
বদরুন্নেছা বলেন, "পত্রিকার মাধ্যমে বিনামূল্যে অস্ত্রোপচারের তথ্য জানতে পেরে মেয়েকে নিয়ে এখানে এসেছি। যারা এই আয়োজন করেছেন, তাদের কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। তাদের কারণেই আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে।"
সিলেটের বিয়ানীবাজারের নাদিম আহমদেরও (১২) ঠোঁট ও তালু কাটা। তার অবশ্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি তখন। তাই বিদেশি ডাক্তার দিয়ে অস্ত্রোপচার হবে শুনে নাদিমকে এখানে নিয়ে আসেন তার মা আমিনা আক্তার পান্না।
তিনি বলেন, "এখানে খুব ভালো অস্ত্রোপচার হয়েছে। দ্রুত বাচ্চার জ্ঞান ফিরে এসেছে। কোনো কষ্টও হয়নি। কিন্তু দেশের ডাক্তারদের দিয়ে এমন অস্ত্রোপচার করাতে ভয় হয়। নানা সমস্যা দেখা দেয়।"
আয়োজক সূত্রে জানা যায়, ১৪ থেকে ২৩ জানুয়ারি সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৬৬ জনের অস্ত্রোপচার হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৬ জন চিকিৎসক ও নার্স এসব অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। গত বছর এই উদ্যোগে ৬৯ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল বলে জানান আয়োজকরা।
এ আয়োজনের ব্যাপারে শেভরন বাংলাদেশের করপোরেট এফেয়ার্সের পরিচালক মোহাম্মদ ইমরুল কবির বলেন, "শেভরন দেশের উত্তর-পূর্বে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিচালনা করে। শেভরন বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের বৃহত্তম উৎপাদক। এর পাশাপাশি এখানকার অর্থনীতি, পরিবেশ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করছে। তারই অংশ হিসেবে ২০১৩ সাল থেকে রোটাপ্লাস্টের সাথে আমরা কাজ করছি। এই উদ্যোগের পুরো অর্থায়ন করছে শেভরন।"
তিনি বলেন, "একটা পরিবারের একটা ঠোঁট কাটা বাচ্চার যখন অপারেশন হয়, তখন তার এবং তার পুরো পরিবারের জীবন চেঞ্জ হয়ে যায়। ফলে এটি একটি লাইফ চেঞ্জিং উদ্যোগ। আমরা এমন উদ্যোগে আগামীতেও সম্পৃক্ত থাকবো।"
এদিকে, গত ২২ জানুয়ারি সিলেট নগরের একটি হোটেলের হলরুমে এই আয়োজনের সমাপনী অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো রেজাউন নবী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল উমর রাশের মুনির, উইমেন্স মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা মো. ওয়েস আহম্ফ চৌধুরী, রোটারি ক্লাব জালালাবাদের প্রেসিডেন্ট মো. আরশাদ আলী, শেভরন বাংলাদেশের করপোরেট এফেয়ার্সের পরিচালক মোহাম্মদ ইমরুল কবির প্রমুখ।