বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাঁধে: অনুদান, প্রকল্প কাটছাঁটে খুঁজছে সমাধান
সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া প্রকল্প গ্রহণ, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে দফায় দফায় সময় বাড়ানোর ফলে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) তিনটি জনসম্পৃক্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে ব্যয় বেড়েছে ৪,৭০৭ কোটি টাকা।
অতিরিক্ত অর্থের প্রায় ১,৬৬৫ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে সরকার। যার সুদ দিতে হবে অন্তত ৭৬০ কোটি টাকা।
এছাড়া, প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে সংস্থাটির নিজস্ব তহবিল থেকে ৭৫৩ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে।
অথচ সীমিত আয়ের বিপরীতে, বিরাট অংকের ঋণের বোঝা চেপেছে সংস্থাটির কাঁধে। আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি নিজস্ব তহবিলের অর্থের যোগান দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিছুক্ষেত্রে কাটছাঁট করে প্রকল্প ব্যয় কমানো এবং অবকাঠামো থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করবে সংস্থাটি। বিরাট অংকের ঋণ বা অর্থের যোগান দিতে প্রয়োজনীয় অর্থ সরকার থেকে অনুদান হিসেবে চাওয়া হয়েছে।
আর্থিক ঘাটতি ও সীমিত রাজস্ব
প্রকল্প তিনটি হলো— নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসন, সিটি আউটার রিং রোড ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ।
সিডিএর বাজেট বইয়ের তথ্যমতে, সংস্থাটির আয়ের মূল উৎস দোকানভাড়া, সঞ্চয় তহবিল থেকে পাওয়া সুদ, ভবন নির্মাণ অনুমোদন ফি, প্লট-ফ্ল্যাট ও দোকান হস্তান্তর ফি, প্লট-ফ্ল্যাট বিক্রির টাকা।
২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৩.১৯ কোটি টাকা মোট পরিচালন ব্যয় ৩৭.৮০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাক্কলিত বাজেটে রাজস্ব আয় ৫৯.৯১ কোটি টাকার বিপরীতে ৫২.৭২ কোটি টাকা পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে।
সিডিএর হিসাব বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিরাট অংকের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা সিডিএর নেই। সিডিএর বর্তমান যে আর্থিক অবস্থা, তাতে ঋণ পরিশোধের জন্য সুদসহ যে টাকা আসবে, তা ১০০ বছরেও পরিশোধ করা সম্ভব নয়।
এই সংস্থাটিও সিটি করপোরেশনের মতো পরিণতি হবে; ঋণের বোঝা নিয়ে চলতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ঋণের পরিমাণ ৪৫০ কোটি টাকা। বহুমাত্রিক আয়ের উৎস থাকলেও এই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নেই। ফলে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীন অবস্থায় রয়েছে সংস্থাটি।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া টিবিএসকে বলেন, "পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সবকিছুতে ব্যবস্থাপনা; সব কিছুতে ভুল ছিল। এসব ভুলের কারণে ব্যয় বেড়েছে। বাড়তি ব্যয় বহনের সক্ষমতা সিডিএর নেই। তাদের পূর্ভাবাসও মিলছে না। ফলে টোল থেকে আদায় করেও ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয়।"
অনুদানের দিকে তাকিয়ে খাল সংস্কার ও উন্নয়ন প্রকল্প
নথিপত্রের তথ্যমতে, 'চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন' শীর্ষক প্রকল্পের শুরুতে ব্যয় ছিল ৫,৬১৬ কোটি টাকা। একলাফে এই ব্যয় ৩,০১০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৮,৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা করা হয়।
প্রকল্পটির বর্ধিত ব্যয়ের মধ্যে অর্ধেক ১,৫০৩ কোটি টাকা অনুদান হিসেবে দিতে রাজি হয়েছে সরকার। বাকি ১,৫০৬ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ঋণ হিসেবে ৭৫৩ কোটি টাকা দেবে। বাকি ৭৫৩ কোটি টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে দিতে হবে।
২০১৭ সালে অনুমোদিত প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ৩ বছর। সাড়ে ৭ বছরে অগ্রগতি হয়েছে ৭২ শতাংশ।
বাস্তবায়নকারী সংস্থার আর্থিক সামর্থ্য অনুযাযী, সরকারি ঋণ ও নিজস্ব অর্থায়নের মোট ১,৫০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা অনুদান ছাড়া প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় বলে চিহ্নিত করেছে সিডিএ।
রিং রোড প্রকল্পে কাটছাঁটের পাশাপাশি টোল আদায়ের চিন্তা
১৩ বছরেও শেষ হয়নি চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড। নগরীর পতেঙ্গা থেকে সাগরিকা পর্যন্ত সমুদ্রপাড়ে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের এই প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১১ সালে। মূল সড়কের কাজ শেষে ২০২০ সালের অক্টোবরে যান চলাচল শুরু হয়েছে। তবে মধ্যপথে ফিডার রোড, সড়ক প্রশস্তকরণসহ নতুন নতুন কাজ যুক্ত করা হয়েছে প্রকল্পের আওতায়।
শুরুতে প্রকল্প ব্যয় ৮৫৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা ছিল। তিন দফা ব্যয় বাড়িয়ে ৩,৩২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা করা হয়েছিল।
সর্বশেষ বৃদ্ধি পাওয়া ৬৪৮ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৮ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিতে রাজি হয় সরকার। কিন্তু এই টোল মুক্ত সড়কটির ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই। এজন্য জমি অধিগ্রহণ, সড়কের দৈর্ঘ্যসহ বিভিন্ন কাজের পরিমাণ কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সংস্থাটি। ব্যয় কমানোর পাশাপাশি ভারী গাড়ি থেকে টোল আদায়ের পরিকল্পনাও করা হচ্ছে।
এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায়ের উপর নির্ভর, তবে রয়েছে শঙ্কা
চট্টগ্রাম নগরীর যানজট নিরসনে ৩,২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে ৪,২৯৯ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
বর্ধিত অর্থের মধ্যে ৫২৪ কোটি টাকা ঋণ। যার সুদ ১৩০ কোটি টাকা। প্রকল্পটির পদে পদে নকশা পরিবর্তন ও র্যাম্প যুক্ত করায় ব্যয় বাড়ে।
এই উড়াল সড়ক থেকে টোল আদায় করছে সিডিএ। টোল থেকে ঋণ পরিশোধের কথা রয়েছে। চলতি মাসে উদ্বোধন হওয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে দৈনিক ৮০ হাজারেরও বেশি গাড়ি চলার কথা। কিন্তু বর্তমানে ৪ হাজারেও কম গাড়ি চলছে। এই হারে গাড়ি চললে বছরে আয় হবে ৩ কোটি টাকারও কম। ঋণ পরিশোধ করতে সময় লাগবে ২৩৫ বছর।
সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আউটার রিং রোড প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে টানেল ইন্টারনেকশন ও ইপিজেড ফিডার সড়ক যুক্ত করা হয়। এখন প্রকল্পের কিছু কাটছাঁট করা হচ্ছে। ফলে ব্যয় কমবে।"
তিনি বলেন, "এই সড়কে চলাচলকারী ভারী যানবাহনের টোল আদায়ের চিন্তা চলছে। জলাবদ্ধতা প্রকল্পের অনুদান হিসেবে অর্থ প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় করা হচ্ছে। র্যাম্প চালু হলে আয় বাড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে।"