চলতি মাসের মধ্যে জুলাই গণহত্যা মামলার একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুত হবে
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন চলতি মাসের মধ্যেই প্রস্তুত হবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বাসস-এর সাথে আলাপকালে এ কথা বলেন।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বাসস'কে বলেন, 'আশা করি, এ মাসের মধ্যে একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন চলে আসবে। এরপর আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হলে তার কয়েক মাসের মধ্যেই মামলা অনুযায়ী একে একে বিচার শেষ হবে বলে আশা করছি।'
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালে চলমান বিচার নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, 'কোন শাসক গোষ্ঠী এরকম ঘৃণ্য কোনো অপরাধ করার দুঃসাহস যাতে না দেখায় সেজন্য নিরপেক্ষতার সাথে জুলাই আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারু ভাবে ও দক্ষতার সাথে পালনে সচেষ্ট।'
এই বিচারের আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখার পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে যেন এই বিচার সম্পন্ন হয় সে আশাও ব্যক্ত করেন চিফ প্রসিকিউটর।
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, যে সকল অপরাধীর বিচার ট্র্যাইব্যুনালে চলছে তাদের অনেক টাকা পয়সা। বিগত সরকারের সময়ে নানা উপায়ে তারা বিপুল অর্থ হাতিয়েছেন। দেশে বিদেশে প্রপাগান্ডার মাধ্যমে তারা এই বিচারটা বিতর্কিত করার জন্য নানামুখী প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের ১৮ কোটি জনগণ ও ছাত্র জনতা তাদের প্রপাগান্ডা রুখে দেবে আমারা এ প্রত্যাশা করছি।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, আন্তর্জাতিক মানের বিচার কার্যক্রম চলবে। তার উপযোগী করে ট্রাইব্যুনাল ভবনকে প্রস্তুত করা হয়েছে। ভবনটি সংস্কারের পূর্বে অনেকটাই জরাজীর্ণ ছিল।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম জানান, জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন বরাবর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। আর ১৭ টি মামলায় ১১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। যাদের মধ্যে ৩৫ জন কারাগারে রয়েছেন। এই ট্র্যাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রমের ১৪ জন প্রসিকিউটর ও ১৭ জন তদন্তকারী কর্মকর্তা যুক্ত রয়েছেন বলে জানান প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম।
প্রসিকিউশন নিয়োগ:
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এডভোকেট তাজুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে ৭ সেপ্টেম্বর নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। আরো ১৪ আইনজীবীকে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন :
গত ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়।
তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাগণ হলেন: পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এডিশনাল ডিআইজি মো. মাজহারুল হক, পুলিশ সুপার (অব.) মুহম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর, মোহা. মনিরুল ইসলাম, মো. জানে আলম খান, সহকারী পুলিশ সুপার সৈয়দ আব্দুর রউফ, পুলিশ পরিদর্শক মো. ইউনুস, মো. মাসুদ পারভেজ, মুহাম্মদ আলমগীর সরকার ও মো. মশিউর রহমান। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) এক্ট-১৯৭৩ এর সেকশন ৮ (১) প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এ এক্টের সেকশন ৩-এর অপরাধসমূহের তদন্ত পরিচালনায় তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। এখন ১৭ জন কর্মকর্তা তদন্ত সংস্থায় যুক্ত রয়েছেন।
অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ১৪ অক্টোবর পুনর্গঠন করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান বিচারপতি গোলাম মর্তূজা মজুমদার। ট্রাইব্যুনালে সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন:
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয় ২৪ নভেম্বর। আইন ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে অধ্যাদেশের গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২০ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে সচিবালয়ে মন্ত্রিসভা কক্ষে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে খসড়া অনুমোদন এবং অধ্যাদেশ জারির সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে বিশিষ্ট আইনজীবী, বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের সাথে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল এক্টকে যুগোপযুগী করতে মত বিনিময় করে আইন মন্ত্রণালয়।
ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শুরু:
গত ১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের পতন হয়।
গত জুলাই-আগস্টে গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার ও তার অনুগত প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে। জাজ্বল্যমান এ অপরাধের বিচার অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে।
জুলাই-আগস্টে সংঘটিত হত্যা ও গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউসন বরাবর এখন পর্যন্ত প্রায় ৩ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। আরও ১৭ টি মামলায় ১১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ট্রাইব্যুনাল। যাদের মধ্যে ৩৫ জন কারাগারে রয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হত্যা, গণহত্যা ও গুলিতে আহতদের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ এখনো দাখিল হচ্ছে। এসব অভিযোগে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এবং আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা, দলীয় ক্যাডারদেরকে আসামি করা হচ্ছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা প্রায় ১৬ বছরের শাসনের পতন হয়। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণ করে। আগামীকাল শনিবার এ সরকারের ৬ মাস পূর্ণ হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী টানা ৩৬ দিনের আন্দোলন নির্মূলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তৎকালীন আওয়ামী লীগ দলীয় ক্যাডারদের হামলায় হাজারের বেশি ছাত্র-জনতা শহিদ হয়েছে। গুলিতে আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে ৫ শতাধিক। চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন চার শতাধিক। আহত হয়েছেন ২৩ হাজার ছাত্র জনতা। তাদের অনেকে এখনো চিকিৎসাধীন।