উদ্যোক্তার শহর হয়ে উঠবে রাজশাহী
রাজশাহী অঞ্চলে বিনিয়োগের অপার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নে এগিয়ে যাচ্ছে এ অঞ্চল। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকায় রয়েছে দক্ষ লোকবল। এখন সঠিকভাবে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে আগামী ৫ বছরের মধ্যে রাজশাহী শহর হবে উদ্যোক্তাদের শহর।
বুধবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড আয়োজিত 'শিল্পায়ন ও বসবাসযোগ্যতা: রাজশাহীর অবস্থান কোথায়?' শীর্ষক এক ওয়েবিনারে এসব কথা বলেন বক্তারা। ওয়েবিনারটি পরিচালনা করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের উপ-নির্বাহী সম্পাদক শাখাওয়াত লিটন।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি সুলতান মাহমুদ সুমন ওয়েবিনারে বলেন, "গত দশ বছরে রাজশাহীতে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহ অবকাঠামোতে যে উন্নয়ন হয়েছে, তা দেখে অনেক বিনিয়োগকারী রাজশাহীতে বিনিয়োগ করার জন্য এসেছেন। রাজশাহী উদ্যোক্তাবান্ধব এলাকা। গত ছয় মাসে ৩০০ নতুন উদ্যোক্তা আমাদের সদস্য হয়েছে। তারা লেদার, জুট, অরগানিক ফুড, সরিষার তেল, হ্যান্ড পেইন্ট, ব্লক, বাটিক, বিউটি পার্লার, আইটি সেক্টরে ব্যবসা করে।"
তিনি বলেন, "এটা আগে ছিল শিক্ষা নগরী। এখন শিক্ষা নগরীর সঙ্গে উদ্যোক্তার শহর হিসেবে গড়ে উঠছে।"
তিনি বলেন, "পাঁচ বছর পরে রাজশাহীতে চাকরি নেওয়ার লোক থাকবে না, তারা চাকরি দিবে। এটা উদ্যোক্তাদের শহর হবে। যেমন চীনে এখন ঘরে ঘরে শিল্প গড়ে উঠেছে। রাজশাহী সেই পথে আছে। আমাদের প্রয়োজন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা। ট্যাক্সের আইনটা জটিল, এটাকে একটু সহজ জায়গায় নিয়ে আসা দরকার। ট্যাক্সের পলিসি যেন সহজ ও উদ্যোক্তাবান্ধব হয়।"
"একটা শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে গেলে ১৭-১৮ টি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। এই লাইসেন্সগুলো যারা দেন তাদের আরও সহযোগিতার মনোভাব থাকতে হবে।"
সুলতান মাহমুদ সুমন আরও বলেন, "দেশে বড় যে গ্রুপগুলোর মালিকানা রাজশাহীর স্থানীয়দের, তারা বিনিয়োগের জন্য আসছে রাজশাহীতে। নাবিল গ্রুপের ৮-১০টি প্রতিষ্ঠান আছে সবগুলোই এ্যাগ্রো বেজ। আমার নিজেরও এ্যাগ্রোবেজ প্রতিষ্ঠান। এ্যাগ্রোবেজ ইন্ডাস্ট্রি হওয়ার জন্য রাজশাহী হলো সবচেয়ে ভালো জায়গা। রাজশাহীতে বিসিক শিল্পনগরী-২ এর আশেপাশে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান জমি কিনছে। প্রাণ গ্রুপ , পার্টেক্স গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ সহ বিভিন্ন বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান রাজশাহীতে জমি কিনছে।"
সুলতান মাহমুদ সুমন বলেন, "আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা শেষ করে রাজশাহীতেই উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। আর যারা সরকারি চাকরি করতে চায় তারা নিজের এলাকায় বসে প্রস্তুতি নিচ্ছে। শীতে প্রতিদিন উদ্যোক্তা মেলা হচ্ছে এখানে। দেশের সবচেয়ে সুন্দর নগরী হিসেবে মানুষ চেনে রাজশাহীকে। আগামী ৩-৫ বছরের মধ্যে উদ্যোক্তাদের নগর হিসেবেও চিনবে।"
তিনি বলেন, "রাজশাহী হলো শস্য ভান্ডার। রাজশাহী অঞ্চল থেকে প্রতিদিন আড়াই কোটি টাকার ১৫০ টন মাছ সরবরাহ হয় সারা বাংলাদেশে। এখন আমরা আমাদের এলাকার পণ্য রপ্তানিতে সার্কভুক্ত দেশের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছি। গত কয়েকদিন আগে নেপালের এ্যাম্বাসেডর এসেছে, সামনে ভুটান, ভারতের এ্যাম্বাসেডর আসবে। নেপাল রাজশাহীর বর্ডার থেকে মাত্র ৩৭ কিলোমিটার দূরে। তারা বলেছে, আমাদের থেকে মাছ, মাংস, ডিম নিবে।
আগামী জুন থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পণ্য নিয়ে ট্রেনে নেপালে যাওয়া যাবে। এখন আমাদের সড়ক যোগাযোগও প্রয়োজন। এ অঞ্চলে আমাদের কৃষি পণ্য উদ্বৃত্ত, আমরা সেগুলো রপ্তানি করতে পারবো।"
রাজশাহী মহিলা চেম্বার অ্যান্ড কমার্সের সভাপতি রোজেটি নাজনীন বলেন, "রাজশাহীর নারী ও পুরুষ উভয়ই উদ্যোক্তা হতে চেষ্টা করছে। নারীরা এগিয়ে আসছে। তারা বাড়ীতে বসে কাজ করছে। নারীরা ঠিকাদারি থেকে শুরু করে জুট মিলে কাজ করছে, কোল্ড স্টোরেজ তৈরী করছে। ৩ জন কোল্ড স্টোরেজ মালিক আছে আমাদের চেম্বারে।
নারীরা তাদের উৎপাদিত হ্যান্ডিক্রাফট সহ বিভিন্ন পণ্য বাজারজাত করার জন্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। আমরা মহিলা চেম্বারের পক্ষ থেকে নারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করি, সহযোগিতা করি। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই, রাজশাহীতে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য যেন আলাদা একটা মার্কেট তৈরী করে দেয়।"
রোজেটি নাজনীন বলেন, "স্থানীয় চেম্বারের সঙ্গে উইমেন চেম্বারের ভালো যোগাযোগ ও সমন্বয় থাকলে উদ্যোক্তাদের কাজের আরও সুবিধা হয়। আমরা ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজকে (এফবিসিসিআই) একটা নতুন প্রস্তাব দিবো যে সব জেলায় উইমেন চেম্বর রয়েছে তাদের সভাপতিকে যেন একটা সাংগঠনিক পদ দেয়া হয়। তিনি যেন ওই চেম্বারের সদস্যপদ লাভ করতে পারে।"
ফ্লিট বাংলাদেশ-এর প্রধান নির্বাহী খায়রুল আলম বলেন, "আমি রাজশাহীকে সিলিকন ভ্যালি হিসেবে দেখতে চাই। আমার প্রতিষ্ঠানে ৫৫০ জন কাজ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সহ স্থানীয় কলেজে পড়ে তারা। কেউ পার্টটাইম কাজ করে, কেউ ফুলটাইম। আমার প্রতিষ্ঠানে কাজ করতো এমন ২০-২৫ জন কর্মী নিজেরাই উদ্যোক্তা হয়েছে।"
খায়রুল আলম বলেন, "প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকায়, রাজশাহী এডুকেশন বেজ অঞ্চল। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসে। তারা কাজ করতে চায়। আইটি সেক্টরে তারা সহজেই কাজ করতে পারে।
ব্যবসা শুরু করার জন্য এখন উদ্যোক্তাদের ওয়ান স্টপ সার্ভিস (ওএসএস) দিতে হবে। ক্যালিফোনিয়ায় উদ্যোক্তারা এক জায়গায় সব সেবা পায়। এমন একটি সুবিধা রাজশাহীতে থাকা প্রয়োজন। এটা হলে সিলিকন ভ্যালি হতে পাঁচ বছরের বেশি সময় লাগবে না।"
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, "রাজশাহীর জন্য এখন একটি ইন্ট্রিগ্রেটেড সাসটেইনেবল প্লান প্রয়োজন। আগামী ১০- ২০ বছরে কি পরিমাণ শিক্ষিত কর্মসংস্থান তৈরী হবে, কোন কোন সেক্টরে কত লোক প্রয়োজন হবে, অবকাঠামো কেমন প্রয়োজন হবে, শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসন ব্যবস্থা সব বিষয়ে এখনই পরিকল্পনা করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজশাহী শহরের মাস্টারপ্লান তৈরী করা প্রয়োজন। নতুন অর্থনৈতিক জোন কোথায় হবে, শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে পরিবেশগত প্রভাব কি হবে- সেসব পরিকল্পনায় থাকতে হবে।"