মেয়াদ বাড়ল চার রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের
প্রায় এক দশক ধরে চুক্তির শর্ত পূরণ করার পর গত বছর থেকে অলস বসে থাকা চারটি গ্যাসচালিত রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
নতুন এ চুক্তির ফলে সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে 'নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট' শর্তের আওতায় বিদ্যুৎ কিনবে। অর্থাৎ কেন্দ্রগুলো যখন 'স্ট্যান্ডবাই' থাকবে, তখন তাদেরকে ভাড়া দিতে হবে না সরকারকে।
নতুন মেয়াদে বিদ্যুতের দামও আগের চেয়ে কমবে। আর একেক কেন্দ্র থেকে একেক মেয়াদে—এক বছর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত—বিদ্যুৎ কেনা হবে। বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পাঁচটি প্রস্তাবের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে একটি গ্যাসচালিত ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রও রয়েছে।
২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি পূরণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে নির্মিত এই চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৬৬০ মেগাওয়াট।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর থেকে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মালিকেরা সরকারকে অনুরোধ করছিল, তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যেহেতু সচল আছে, তাই তাদেরকে যেন প্রয়োজন হলে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়।
এমন এক সময় এই মেয়াদ বাড়ানো হলো, যখন বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উনয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা এবং সিস্টেমে অতিরিক্ত সক্ষমতা রাখার জন্য লোকসান দিয়ে যাচ্ছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বিপিডিবি প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। বিশ্ববাজারে ক্রমাগত গ্যাস ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছে রাষ্ট্রের একমাত্র এই বিদ্যুৎ-ক্রেতা।
তবে কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞ উভয়পক্ষই মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে মত দিয়েছে। তারা বলছেন, এই মেয়াদ বাড়ানো উভয় পক্ষের জন্যই লাভজনক হবে।
বুধবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, যখন প্রয়োজন হবে, তখনই সরকার এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনবে। এবং সরকার বিদ্যুৎ কিনলেই কেবল এসব কেন্দ্রকে টাকা দেবে।
এছাড়াও তিনি জানান, নতুন মেয়াদে বিদ্যুতের ক্রয়মূল্যও আগের চেয়ে কমবে।
সরকার এসব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনার জন্য মাত্রাতিরিক্ত ভর্তুকি দিচ্ছে। এর ফলে আর্থিক ক্ষতিতে পড়ছে বিদ্যুৎ খাত। এ নিয়ে সরকার ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
নতুন চুক্তির আওতায় সিলেটের কুমারগাঁওয়ের ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ এক বছর এবং ফেঞ্চুগঞ্জের ৫০ মেগাওয়াট ও বগুড়ার ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। এই তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক হোসাফ গ্রুপের অঙ্গসংগঠন এনার্জি প্রাইমা লিমিটেড।
ইউনাইটেড এনার্জি লিমিটেডের মালিকানাধীন আশুগঞ্জ ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে পাঁচ বছর।
কুমারগাঁও ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতি ইউনিট (প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা) বিদ্যুতের নতুন দাম হয়েছে ১ টাকা ৯৭ পয়সা হয়েছে। আগে প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ২ টাকা ৬১ পয়সা। ফেঞ্চুগঞ্জের ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের আগের দাম ছিল প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৭৮ পয়সা। নতুন চুক্তিতে সেই দাম এখন কমে হয়েছে প্রতি ইউনিট ২ টাকা ১২ পয়সা।
এদিকে বগুড়ার ২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম ছিল প্রতি ইউনিট ২ টাকা ৫১ পয়সা। নতুন চুক্তির পর এখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে ২ টাকা ০৩ পয়সা। আর আশুগঞ্জ ৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম আগের চুক্তিতে প্রতি ইউনিট ৩ টাকা ২৮ পয়সা। এখন নতুন চুক্তিতে সেখানকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের হবে ২ টাকা ৪৩ পয়সা।
বুয়েট অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, 'নো ইলেক্ট্রিসিটি, নো পেমেন্ট' শর্তের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানোতে সরকার ও বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিক উভয়পক্ষই লাভবান হবে।
তিনি বলেন, 'সরকার তেলনির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করে না থেকে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারবে।'
তিনি আরও বলেন, কয়লাভিত্তিক বড় প্রকল্পগুলো চালু না হওয়া পর্যন্ত রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসা যাবে না।
বর্তমানে জেনারেশন সিস্টেমে ১৫টি কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলোকে ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রায় ৩ হাজার ৩২৮ কোটি টাকা দিতে হয়েছে।
২০০৯ সালের ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের জন্য অনেকগুলো রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন দেয়।
এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ২০২৪ সালের মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে। তবে পরে মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
অনুমোদন পেল নতুন গ্যাসভিত্তিক ৬৬০ মেগাওয়াটের নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র
বুধবার সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি নতুন গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়। কনফিডেন্স পাওয়ার হোল্ডিংস লিমিটেড, জিই কেপিটাল ইউএস হোল্ডিংস, কনফিডেন্স পাওয়ার এবং ইলেকট্রোপ্যা ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের মিলিত কনসোর্টিয়াম এই কেন্দ্রটি স্থাপন করবে।
কনফিডেন্স গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান ইমরান করিম জানান, তারা ২০২৬ সালের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন।
তিনি বলেন, 'আমরা প্রস্তাব জমা দিয়েছিলাম ২০১৯ সালে। কিন্তু মহামারির কারণে দেরি হয়ে গেছে। তবে আমরা আগামী জুলাইয়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় সমস্ত চুক্তি সম্পন্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি।'
বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের ১০টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। এই ১০টি কেন্দ্রের সম্মিলিত উৎপাদন সক্ষমতা ১৩০১ মেগাওয়াট।