ধীরগতির ট্রেন, শ্লথগতির প্রকল্পে বেহাল রেলওয়ে
ভারতে প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন চালু হয় ১৮৫৩ সালে, যা ৪০০ যাত্রী নিয়ে মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমান পাকিস্তান যে অঞ্চল নিয়ে গঠিত সেখানে আরো দুই বছর পর আসে রেলের যাত্রী পরিষেবা।
পূর্ব বাংলা যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়, সেখানে এ সেবা আসে আরও পরে ১৮৬২ সালে।
সাবেক ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিবেশী দেশগুলোতে একই দশকে ট্রেনের যাত্রী পরিষেবা চালু হলেও; প্রত্যেকের ভাগ্য এক হয়নি।
রেলওয়ে খাতের দ্রুত উন্নয়ন করে ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই একে তাদের জাতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে গড়ে তুলছে, বাড়িয়েছে রেল নেটওয়ার্কের ব্যাপ্তি। সে তুলনায় এ দুদিক থেকেই পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।
এ দেশের রেল পরিষেবা একদিকে যেমন উন্নয়ন ও অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; তেমনিভাবেই নিজস্ব ধীরগতির ট্রেনের মতো মন্থর রেলওয়ের প্রকল্পগুলো।
সম্প্রতি গোল্ডেন কোয়াডলিটেরাল- গোল্ডেন ডায়াগনাল রুটে দ্রুতগতির এক নতুন ট্রেন চালু করেছে ভারতীয় রেলওয়ে, যা প্রতিঘন্টায় সর্বোচ্চ ১৩০ কিলোমিটার গতিতে ছুটতে পারবে। অন্যদিকে, ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতির ট্রেন সেবা চালুর পরিকল্পনা করছে পাকিস্তান।
উচ্চগতির এসব রেলগাড়ি প্রকল্প বাদ দিলেও, ভারত ও পাকিস্তানে ট্রেনের গড় গতি যথাক্রমে ঘণ্টায় ১৮০ ও ১৩০ কি.মি.।
যার বিপরীতে বাংলাদেশে ট্রেনের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৭০-৮০ কিলোমিটার। কিছু কিছু রুটে সে গতি আরও মন্থর।
রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের (বিআর) কাছে এমন ট্রেনও রয়েছে যা প্রতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে যেতে পারে, কিন্তু অবৈধ ক্রসিং ও যানজটের কারণে সেই গতিতে চলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, "আমরা যদি সম্ভাব্য পূর্ণ গতিতে ট্রেন চালাই, তাহলে দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়বে।"
রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) সরদার সাহাদাত আলী জানান, ব্রডগেজ লাইনে সর্বোচ্চ গতি ছিল ১০০ কিলোমিটার, অন্যদিকে মিটারগেজ লাইনের যাত্রীবাহী ট্রেন প্রতিঘন্টায় ৭৫ কি.মি. গতিতে চলতে পারত। উচ্চগতিতে ট্রেন চালানোর জন্য মিটারগেজ লাইন উপযুক্ত নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
রেলপথে থাকে পাশাপাশি বেছানো দুটি রেইল, যার ওপর দিয়ে রেলগাড়ি চলে। এই দুটি রেইলের মধ্যেকার দূরত্বের পার্থক্য অনুসারেই নির্ধারিত হয় রেলওয়ে গেজ। ভারতে ব্রডগেজ ট্র্যাকের দূরত্ব ১,৬৭৬ মিলিমিটার, যাতে বেশি গতিতে ট্রেন চালানো সম্ভব হয়। অন্যদিকে, খরচ কম হলেও মিটারগেজ ট্র্যাকের পরিধি মাত্র ১,০০০ মিলিমিটার।
মাত্র একটি রুট ছাড়া ভারতে আর মিটারগেজ রেলপথ ব্যবহার হয় না। পাকিস্তানও এটি বাতিল করা শুরু হয়েছে।
পক্ষান্তরে বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল ব্রডগেজ ট্র্যাক দ্বারা আচ্ছাদিত হলেও মিটার গেজ ব্যবহার করা হয় পূর্ব দিকে।
পরিবহন ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. শামসুল হক আরেকটি দুর্বলতা চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেন, "অন্যান্য দেশে পরিচালনা (অপারেশন) এবং রক্ষণাবেক্ষণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, কিন্তু এখানে সেসবই মূলত অবহেলিত। আমরা কেবল বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলি কীভাবে নিতে হয় তা জানি, তবে রক্ষণাবেক্ষণকে গুরুত্ব-সহকারে গ্রহণ করিনি।"
নদীভাঙ্গনের ক্ষতিকর প্রভাব রেলপথে পড়ার দিকে আলোকপাত করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, "রেলওয়ের বাঁধগুলোয় বাস্তুহারা মানুষও আশ্রয় নেয়, ফলে আরও অবৈধ ক্রসিং ও স্থাপনার চাপে আগামীতে ট্রেনের গতি আরও কমবে বলে মনে হচ্ছে।"
শামসুল হক আরও উল্লেখ করেন যে, বিদ্যমান ট্রেনগুলির সর্বোচ্চ গতি নিশ্চিত করতেও কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি।
বৈশ্বিক গতির সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের ট্রেনের গতির দশা আরও মলিনই দেখায়।
মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএন- এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগামী ট্রেন সেবা আছে চীনের, যার সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৬০০ কিলোমিটার। তারপরেই আছে জার্মানি, সেখানে সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩৩০ কিলোমিটার।
ভারতীয় উপমহাদেশে যে ব্রিটেনের মাধ্যমে প্রথম বাস্পচালিত লোকোমোটিভ ট্রেন চালু হয়েছিল, সে দেশটিতে এখন ঘন্টায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে এমন ট্রেন রয়েছে।
নিস্তেজ উন্নয়ন প্রকল্প
বাংলাদেশ রেলওয়ে বারবারই আপগ্রেডেশনের পরিকল্পনা নিয়েছে। কিন্তু এই প্রকল্পগুলোর সিংহভাগই সফলভাবে শেষ হয় না।
গত বছর বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি উচ্চ-গতির ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাই করে। এ লাইনে ট্রেন চলবে ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার গতিতে। কিন্তু তহবিলের অভাবে এ প্রকল্পের কাজ আর এগোয়নি। কোনো-না-কোনো কারণে এরকম আরও অনেক প্রকল্প আটকে গেছে।
৭০ মিটারগেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ কেনার ছয় বছর মেয়াদি প্রকল্প এক দশক পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি।
এরকম আরও তিনটি চলমান রেলওয়ে প্রকল্প এক দশক ধরে শামুকের গতিতে চলছে। এসব প্রকল্পে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে একাধিকবার। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খরচও। আর এসব প্রকল্পের অগ্রগতিও প্রশ্নবিদ্ধ।
রেলওয়ের ১ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার মোট ৪১টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি প্রকল্পের সময়সীমা চারবার পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সেইসঙ্গে ব্যয়ও পরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি বাড়ানো হয়েছে।
প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন আরেকটি উদাহরণ। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে নেওয়া প্রকল্পটি জুন ২০১৪ সালের দিকে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক দশকেরও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর- এ প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে হবে আরও এক বছর।
সম্প্রসারণ অতি সামান্য
কয়েক দশকে সারা দেশকে যুক্ত করতে ৬৭ হাজার ৯৫৬ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করেছে প্রতিবেশী ভারত। পাকিস্তানের রেললাইনের মোট দৈর্ঘ্য ১১ হাজার কিলোমিটার। আর বাংলাদেশের মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার। এই দৈর্ঘ্যই বলে দেয়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতালাভের সময় ভারতের অংশে রেললাইন ছিল প্রায় ৫৩ হাজার ৫০০ কিলোমিটার এবং পাকিস্তানের অংশে ছিল প্রায় ১০ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যানুসারে, পাকিস্তানের মোট ১০ হাজার ৭০০ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল ২ হাজার ৮০০ কিলোমিটার।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বছরগুলোতে ভারত তার রেলওয়ে নেটওয়ার্ক ১৪ হাজার ৩৯০ কিলোমিটার সম্প্রসারিত করেছে, পাকিস্তান তার রেললাইনের দৈর্ঘ্য বাড়িয়েছে প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার।
কিন্তু পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশ তার বিদ্যমান রেলওয়ে নেটওয়ার্কে যোগ করেছে মাত্র ১৫৫ কিলোমিটার। বরিশাল, বান্দরবান ও কক্সবাজারসহ ১৫টি জেলা এখনও বাংলাদেশ রেলওয়ের নেটওয়ার্কের বাইরে রয়ে গেছে।
রেলপথ সম্প্রসারণের ধীরগতির বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন বিগত সরকারকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, "সম্প্রসারণ না করে পূর্ববর্তী সরকারগুলো কিছু স্টেশন আর রুট বন্ধ করে দিয়েছে।"
রেলমন্ত্রী আরও বলেন, "বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই কিন্তু রেলপথ সম্প্রসারণে নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে। আমরা ইতিমধ্যে কিছু বন্ধ রুট খুলে দিয়েছি। আর পায়রা রেল লাইন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার লাইন এবং আখাউড়া-আগরতলা লাইনের মতো কিছু নতুন রেললাইন নির্মাণ করছি।"
সম্পূর্ণ দোষই অবশ্য আগের বা বর্তমান সরকারের নয়। রেলপথ সম্প্রসারণ না হওয়ার ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক এবং প্রযুক্তিগত কারণও তুলে ধরেছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. শামসুল হক বলেন, "ব্রিটিশরা প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলোতে রেলপথ সম্প্রসারণ করেছিল। আর আজকের বাংলাদেশ এসব ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ ছিল না। কাজেই এই অঞ্চল ব্রিটিশ রাজের কাছে উপেক্ষিত থেকে গেছে।"
তিনি বলেন, রেলপথ সম্প্রসারিত না হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, এ অঞ্চলের জমিতে নরম পলল মাটির উপস্থিতি। এই মাটির কারণে রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক বেড়ে যায়।
"তবে স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে আমরা ভারসাম্যপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ভিত্তিতে কোনো নীতিমালা তৈরি করিনি। উল্টো আমরা এমন একটা সিস্টেম তৈরিতে মনোযোগ দেই যা দাতা দেশগুলোর দরকার ছিল,"- যোগ করেন তিনি।