উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনশন করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শাবির আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে টানা আন্দোলনরত শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। অনশন শুরুর দ্বিতীয় দিনে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১০ জন অনশনকারী অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদের মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া বুধবার রাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় আরও দুই শিক্ষার্থীকে।
তারপরও আন্দোলন থেকে সরে না যাওয়ার ঘোষণা শিক্ষার্থীদের। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে বারবার আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া হলেও- তা ফিরিয়ে দিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) দুই দফায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষক আন্দোলনকারীদের কাছে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে যান। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনে সংহতি না জানানো কারো সাথে আলোচনা করতে রাজী হননি।
এদিকে, বৃহস্পতিবার বিকেলে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে।
অসুস্থ আন্দোলনকারীরা:
আমরণ অনশনে বসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এদের মধ্যে কাজল দাস ও মরিয়ম বেগম নামের দুজনকে বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরও ৮ জনের হাতে অনশনস্থলেই স্যালাইন লাগানো হয়েছে।
উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪ জন বুধবার দুপুর থেকে অনশন শুরু করে। তীব্র শীত আর অনাহারে রাতভর রাস্তায় থাকায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাদের শরীর খারাপ হতে থাকে। বেলা ১২টার দিকে একজন চিকিৎসক তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান।
বেলা একটার দিকে কাজল দাস নামের এক অনশনকারীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। সাথে সাথে তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কাজল পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
শিক্ষার্থীরা জানান, রাতে কাজলের কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। তার রক্তচাপ কমে যায়। বিকেলে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় মরিয়ম বেগম নামে আরেক শিক্ষার্থীকে।
যে হাসপাতালে তাদের ভর্তি করা হয়েছে সেখানকার চিকিৎসক বাবলু হোসেন বলেন, রক্তচাপ কমে যাওয়া ও জ্বরে তাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল। তবে হাসপাতালে আনার পর অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে।
অনশনস্থলে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আরও ৮ শিক্ষার্থী। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাদের স্যালাইন পুশ করা হয়েছে।
এরআগে বুধবার রাতে আন্দোলন চলাকালে অসুস্থ হয়ে পড়েন দুই শিক্ষার্থী। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে শিক্ষকরা:
বৃহস্পতিবার দুপুরে দুই দফায় শিক্ষক প্রতিনিধিরা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা করতে আসেন। তবে শিক্ষার্থীরা আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলামের নেতৃত্বে বৃহস্পতিবার দুপুরে অর্ধশতাধিক শিক্ষক উপাচার্যের বাসভবনের সামনে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করতে যান।
তবে এ সময় শিক্ষার্থীরা জানান, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে তাদের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি না জানালে শিক্ষকদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করবেন না।
শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে এক বিবৃতিতে দিয়ে জানিয়েছেন, 'প্রয়োজনে বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে এ ঘটনার জন্য দায়ীদের খুঁজে বের করা হবে। যার দোষ পাওয়া যাবে তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আন্দোলনে তারাও শরিক হবেন।'
তবে শিক্ষকদের এমন কথায় আশ্বস্ত না হয়ে আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন শিক্ষার্থীরা। পরে শিক্ষকরা সমঝোতায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান। তবে যাওয়ার আগে জানিয়ে যান, আলোচনার জন্য আবারও আসবেন।
এরপর বেলা আড়াইটার দিকে আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে আবারও আসেন এই শিক্ষকরা। তবে তাতেও সম্মত হননি শিক্ষার্থীরা।
বৃহস্পতিবার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পক্ষে সংবাদমাধ্যমে কথা বলেন শিক্ষার্থী নাফিজা আনজুম। তিনি বলেন, 'যে উপাচার্য শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলির নির্দেশ দেন। তার কাছে আমরা শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই নিরাপদ অনুভব করছি না। তার অধীনে আমরা কিছুতেই ক্লাসে ফিরে যাব না। তাকে পদত্যাগ করতেই হবে।'
শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে সমাধানের আহ্বান পরিকল্পনামন্ত্রীর :
আলোচনা করে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান।
বৃহস্পতিবার সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিরতা প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, এই বয়সে শিক্ষার্থীদের একটু উত্তেজনা থাকতেই পারে। একটু সময় দিয়ে, বুঝিয়ে, তাদের সঙ্গে কাজ করে সব সমাধান করতে হবে। কোনো হঠকারি বিষয় যেন তাদের ওপর চাপিয়ে না দেওয়া হয়। পরিস্থিতি ধৈর্যের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে হবে। শাবির ঘটনায় যেন আগুনে ঘি না ঢালা হয়।
তিনি বলেন, 'শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবি) যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান। আমরা তাদের ছেড়ে যেতে পারি না। তাদের মঙ্গল চাই। সুতরাং এই ব্যাপারে বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।'
সংহতি জানাতে বিএনপি নেতারা:
বৃহস্পতিবার বিকেলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি জানাতে ক্যাম্পাসে আসেন সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতারা। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকীর নেতৃত্বে মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব মিফতাহ সিদ্দিকী, যুগ্নআহ্বায়ক এমদাদ হোসেন, বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান কয়েস লোদী, জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি সালেহ আহমদ খসরুসহ বিএনপি নেতারা উপাচার্য ভবনের সামনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এসে সংহতি জানান।
এসময় মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুল কাইয়ুম জালালী পংকী বলেন, 'একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা এই আন্দোলনে সংহতি জানাতে এসেছি। শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে আমরাও একমত। এই উপাচার্যের অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।'
প্রসঙ্গত, এক হল প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার থেকে আন্দোলন শুরু করে শাবির সিরাজুন্নেছা হলের ছাত্রীরা। রোববার তারা উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদকে অবরুদ্ধ করে রাখলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে উপাচার্যকে মুক্ত করে। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অর্ধ-শতাধিক আহত হন। ওই রাত থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। বুধবার থেকে অনশন শুরু করেন তারা।