বিআরটি-৩ লক্ষ্য ছুঁতে কেন বার বার ব্যর্থ হচ্ছে?
ঢাকা এয়ারপোর্ট রেলওয়ে স্টেশনের সামনে দুটি প্লাক্যার্ড স্থাপন করেছে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্র্যানজিট কর্তৃপক্ষ। দুই প্ল্যাকার্ডেই আছে আকর্ষণীয় প্রতিশ্রুতি: "বিআরটি লেনে প্রতি ৩০ সেকেন্ড অন্তর বাস চলবে। বিআরটি দিয়ে মাত্র ৩৫-৪০ মিনিটে এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর যেতে পারবেন যাত্রীরা।"
কিন্তু, এই অঙ্গীকার এরমধ্যেই ভঙ্গ করা হয়েছে।
নয় বছর আগে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শুরু হলেও, ধারাবাহিক দেরির ফলে টঙ্গী মহাসড়ক হয়ে ঢাকা থেকে গাজীপুর যাতায়াত যাত্রীদের জন্য মূর্তিমান দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে।
২০.৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বাস র্যাপিড ট্র্যানজিট রুট (বিআরটি) নির্মাণ কাজের ধাক্কায় ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়ক এখন অসংখ্য খানাখন্দে ভর্তি। ফলে যাত্রীদের নিত্য দুর্ভোগের সাথে সাথে আশেপাশের এলাকার ব্যবসায়ীরাও প্রতিনিয়ত বিপুল আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।
নির্ধারিত সময়ে শেষ হওয়া নিয়ে সংশয়:
বর্তমানে প্রকল্পের কাজ আরও একবার পিছিয়ে পড়ায় ঠিকাদারদের আল্টিমেটাম দিতে বাধ্য হয়েছে সরকার। সংশোধিত সময়েও কাজ শেষ করা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রকল্পের শীর্ষ কর্মকর্তাদের আস্থায় ঘাটতি রয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ছিল ৬৮ শতাংশ। গত বছরের জুলাই পর্যন্ত, অগ্রগতি ছিল ৬১ শতাংশ, অর্থাৎ গত পাঁচ মাসে বাস্তবায়ন হয়েছে মাত্র ৭ শতাংশ।
এর পিছনে প্রধান সমস্যা হল সবচেয়ে কম দরদাতা ঠিকাদার, তারাও এখন লোকসান গুনছে। তারা যত বেশি সময় ধরে কাজ করেছে, খরচও তত বেশি বেড়েছে। প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় প্রক্ষেপণে ২ হাজার ৩৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হলেও তা এখন এখন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে।
ঠিকাদারদের তহবিল সংকট:
প্রকল্পের এলিভেটেড অংশের প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খান বলেন, "যা হয়েছে তা হলো ঠিকাদার (জিয়াংশু প্রভিন্সিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড) সবচেয়ে কম দর দিয়ে টেন্ডার জিতেছে। এখন, যেহেতু এটি লোকসানের মধ্যে রয়েছে, এটি ঢিলেঢালাভাবে হচ্ছে। ফলে দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।"
প্রকল্পের এই কর্মকর্তা আরও জানান যে, নির্বাচিত ঠিকাদাররা সময়মতো কাজ শেষ করার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল সুরক্ষিত করছে না, কারণ তাদের মূল কোম্পানি সব সময় অর্থ দিয়ে সহায়তা করে না।
মহিরুল বলেন, "আপনি যদি এক কিউবিক মিটার নির্মাণ করেন, খরচ হবে ২৭ হাজার টাকা। তারা যে দর দিয়েছে সে কারণে আমরা তাদের ১৩ হাজার টাকা করে দেই।"
আরেকটি ঠিকাদার, চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড প্রকল্পের অ্যাট গ্রেড অংশটি নির্মাণ করছে। জুলাই ২০২১ পর্যন্ত তাদের ভৌত অগ্রগতি ছিল ৬১.৭০ শতাংশ, যা গত বছরের ডিসেম্বরে বেড়ে ৭১ শতাংশ হয়েছে।
দেরির ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) জানান, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই কাজ শেষ করতে সরকার এখন আল্টিমেটাম দিয়েছে।
পিডি মহিরুল বলেন, "আমাদের ২০২২ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই ঠিকাদারকে সতর্ক করে জানিয়েছি যে এই সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে।"
সংশোধিত সময়সীমার মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে কিনা তা নিশ্চিত কিনা জানতে চাইলে অবশ্য দ্বিধা প্রকাশ করেন মহিরুল।
"ঠিকাদারকে যখনই কাজ শেষ করতে বলি, ওরা বলে যে ওদের কাছে টাকা নেই। এরপর ওরা যে নগদ অর্থ না থাকায় কাজ করতে পারেনি, তা জানিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একটি প্রতিবেদন পাঠাই। এই তো। আমি আর কী করতে পারি?"- বলেন তিনি।
প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, তারা সময়সীমা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য বলেছে। এর অর্থ, চার বছরের প্রকল্পটি শেষ করতে সময় লাগবে এক দশকেরও বেশি।
ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে যানজট নিরসনের জন্য ২০১২ সালে সরকার দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প (বিআরটি-৩) হাতে নেয়, যা ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
'ঠিকাদারকে যখনই কাজ শেষ করতে বলি, ওরা বলে যে ওদের কাছে টাকা নেই। এরপর ওরা যে নগদ অর্থ না থাকায় কাজ করতে পারেনি, তা জানিয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একটি প্রতিবেদন পাঠাই। এই তো। আমি আর কী করতে পারি?' বলেন তিনি।
প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, তারা সময়সীমা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর জন্য বলেছেন। এর অর্থ, চার বছরের প্রকল্পটি শেষ করতে সময় লাগবে এক দশকেরও বেশি।
ঢাকা-গাজীপুর মহাসড়কে যানজট নিরসনের জন্য ২০১২ সালে সরকার দেশের প্রথম বাস র্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প (বিআরটি-৩) হাতে নেয়, যা ২০১৬ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
টাকা নেই, নেই উপকরণও:
প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম খান বলেন, প্রকল্পের ঠিকাদার জিয়াংসু প্রভিনশিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডও উৎস উপকরণের সমস্যায় ভুগছে।
এলিভেটেড অংশ নির্মাণের জন্য নানা ধরনের বিস্তর উপকরণ প্রয়োজন। কিন্তু অর্থ দিতে বিলম্ব হওয়ায় সরবরাহকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
মহিরুল বলেন, ঠিকাদাররা ইতিমধ্যে বাকিতে উপকরণ কিনেছে এবং তাদের বকেয়া পরিশোধ করতে পারেনি। একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একটি রড কোম্পানি আগের বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করলে আর কোনো উপকরণ সরবরাহ করতে অস্বীকার করে।
ঠিকাদার অনেকবার নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের চেষ্টাও করেছে বলে দাবি করেন প্রকল্প পরিচালক। উপকরণগুলো মান যাচাইয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হলে নতুন করে কিনতে হয়েছিল। এর ফলে আরও সময় নষ্ট হয়েছে বলে জানান তিনি।
সময়মতো টাকা না পাওয়ায় অনেক সাব-কন্ট্রাক্টরও কোম্পানিটির সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
'সাব-কন্ট্রাক্টররা যখন বুঝল শিগগিরই টাকা পাওয়ার সম্ভাবনা কম, তখনই তারা কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এমনটাও ঘটছে,' মহিরুল বলেন।
প্রকল্পের গ্রেড অংশের প্রকল্প বাস্তবায়নের গতিও সন্তোষজনক নয়। কাজ পাওয়ার জন্য সর্বনিম্ন দর হাঁকিয়েছিল ঠিকাদার চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানও নগদ অর্থ সংকটে রয়েছে।
গ্রেড অংশের প্রকল্প পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ বলেন, তারা প্রকল্পটি বাতিলের উদ্যোগ নিতে পারতেন, কিন্তু রিটেন্ডারিং প্রক্রিয়ায় আরও সময় লাগবে বলে তা করেননি।
তিনি বলেন, আশা করছি ২০২২ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন হবে। তিনি আরও বলেন, ঠিকাদারও ওই সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করার আশা করেছিল।
প্রকল্প পরিচালক মহিরুল ইসলাম অবশ্য ইলিয়াস শাহের মতো আশাবাদী হতে পারেননি।
তিনি বলেন, তারা উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করছেন এবং ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, অর্থাৎ আরও দেড় বছর সময় বাড়ানোর আবেদন করবেন।
মহিরুল বলেন, 'এর মধ্যে বাস কেনাও রয়েছে। কর্তৃপক্ষ ১০৩টি বাস কিনবে। আর বাস মালিকদের সাথে আলোচনা করতে হবে আমাদের।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা বুঝতে পারছি যে ওই সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করা যাবে না। এজন্য আমরা সময়সীমা আরেকবার সংশোধিত করে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করতে বলেছি।'
এদিকে প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারা এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে চীনা দূতাবাসসহ চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন।
তবে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না বলেও জানান তারা। কারণ চুক্তিটি বাতিল হলে বিজয়ী দরদাতারা আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করতে পারে। এরপর সেই মামলার রায় না আসা পর্যন্ত প্রকল্প বন্ধ রাখতে হবে।
মনিরুল বলেন, 'এখন অন্তত কিছু কাজ তো হচ্ছে। সড়কে এখন যানবাহন চলাচল করছে, কিন্তু মামলা হলে যানবাহন চলাচলও বন্ধ হয়ে যাবে। আদালত নিষেধাজ্ঞা দিলে রাস্তায় আর কিছু করা যাবে না।'
'রায়ে আমাদের জেতার বিশাল সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমরা জিতব দুই বছর পরে। এই দুই বছর রাস্তার দেখাশোনা করবে কে? সরকার এটা বোঝে,' বলেন তিনি।