যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা, প্লট মালিকানা সংক্রান্ত অভিযোগে বধির রাজউক
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১৯৯৬ সালে ১১ লাখ টাকায় লটারির মাধ্যমে ৫ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ পান ঢাকার মিরপুরের ব্যবসায়ী শরিফুল ইসলাম। প্লটটি পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন।
কিন্তু তার আনন্দ উবে যেতে সময় লাগেনি। প্লটটির রেজিস্ট্রেশন করতে গিয়ে শরিফুল জানতে পারেন, ওই একই প্লট আরেক ব্যক্তির নামে বরাদ্ধ হয়েছে। ফলে শরিফুলের নামে প্লটটির রেজিস্ট্রেশন করা সম্ভব হয়নি।
এই ভুল সংশোধনের জন্য রাজউকের সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন শরিফুল ইসলাম। কিন্তু ৮ বছরেও এর সমাধান দিতে পারেনি সংস্থাটি।
আট বছর পর হতাশ শরিফুল ওই প্লটের যথাযথ মালিকানা দাবি করে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন এবং নিজের মালিকানায় প্লটটি দখলে দিতে নির্দেশনা চান। মামলায় মূল বিবাদী করা হয় রাজউককে। কিন্তু ১৮ বছরেও এ প্লট বুঝে পাননি শরিফুল।
শরিফুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত ১৭ বছরের শতাধিকবার আদালতের যেতে হয়েছে। খরচও করতে হয়েছে ৬ লাখের বেশি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান পাইনি। ইতোমধ্যে পূর্বাচলের ২ নম্বর সেক্টরের ওই প্লটের চারপাশে বাড়ি নির্মাণ করা শুরু হয়েছে। আমারটা এখনও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।'
ওই একই প্লট বরাদ্দ পাওয়া অপর ব্যক্তি হলেন সরকারি চাকরীজীবী মোসলেম উদ্দিন। তিনিও এ সমস্যার সুরাহা হতে বিলম্ব হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন। তার কাছ থেকেও এ প্লটের জন্য ১১ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছিল।
প্লট একটি, বরাদ্দ পেয়েছেন অনেকে
শরিফুল ও মোসলেম উদ্দিনের মতো এরকম ৫৭৭টি প্লট দুই, এমনকি তিনজন ভিন্ন ব্যক্তির নামে বরাদ্দ হয়েছে রাজধানীর উপকণ্ঠে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে।
এই জটিলতার সমাধান হয়নি গত দুই যুগেও। এখনও এই ৫৭৭টি প্লট নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে।
সূত্রমতে, এই ৫৭৭টি প্লটের মালিকানার দাবি মামলাসহ পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় দেড় হাজার মামলা রয়েছে রাজউকের বিরুদ্ধে।
রাজউক ১৯৯৫ সালে প্রায় ২৬ হাজার প্লট ও ৬৬ হাজার ফ্লাট নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে রাজধানীর অদূরে রূপগঞ্জ ও কালিগঞ্জ উপজেলা এলাকায় দেশের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে।
শুধু পূর্বাচল নয়, কেরানীগঞ্জ এলাকায় ঝিলমিল প্রকল্পেও ৩৩৮টি প্লট এরকম একাধিক ব্যক্তির নামে বরাদ্দ হয়েছে। উত্তরা তৃতীয় শহর প্রকল্পে একই ঘটনা ঘটেছে ৩০৬টি প্লটের ক্ষেত্রে। উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে এরকম ৮১টি অ্যাপার্টমেন্টও বরাদ্দ হয়েছে একাধিক ব্যক্তির নামে।
সংশ্লিষ্টরা টিবিএসকে জানিয়েছে, রাজউকের বিরুদ্ধে নানা কারণে প্রায় ৮ হাজার ৭০০টি মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে বছরের পর বছর ধরে। এই মামলাগুলোর মধ্যে ১৫ বছরের বেশি পুরোনো মামলা রয়েছে প্রায় দেড় হাজার, ১০ বছরের বেশি সময় ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে প্রায় ৩ হাজার মামলা। চলমান এই মামলাগুলোর সঙ্গে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা জড়িত।
৮ হাজার ৭০০টি মামলার মধ্যে রিট মামলা রয়েছে প্রায় ৭ হাজার, যেগুলো হাই কোর্টে বিচারাধীন। বাকিগুলো বিচারিক আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এই মামলাগুলো ছাড়াও বিভিন্ন কারণে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজউকে প্রায় ১ হাজার ২৫০টি অভিযোগ এখন পর্যন্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে বলে প্রতিস্টানটির একটি সুত্র জানিয়েছে। এর মধ্যে ৫ থেকে ৮ বছর আগে দায়ের করা অভিযোগও রয়েছে।
অধিকাংশ মামলাই করা হয়েছে রাজউকের প্রকল্পে আইনবহির্ভূত প্লট বরাদ্দ, একই ব্যক্তির নামে একাধিক প্লট বরাদ্দ, ভুল ম্যাপ প্রণয়ন এবং ভুল পরিকল্পনা সংশোধনের জন্য। এছাড়াও যথাযথ যাতায়াত ব্যবস্থা করা, জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং যথাযথ রাস্তা ও ড্রাইভওয়ে করার জন্যও অনেক মামলা করা হয়েছে।
মামলার পাহাড় গড়ে উঠলেও প্রতি বছর নিষ্পত্তি হওয়া মামলার সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালে মাত্র ৮১টি রিট নিষ্পত্তি হয়েছে। ২০২০ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১২টি এবং ২০১৯ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে ২০৮টি রিট পিটিশন।
প্লট বরাদের অনিয়ম নিয়ে পৃথক ৮ রিটকারীর আইনজীবী ব্যারিস্টার শাহরিয়ার কবির বলেন, 'রাজউকের এই রিটগুলো নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্প যথাযথ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ বেশ কয়েকটি রিটে হাইকোর্ট কয়েকটি সেক্টরের প্লট বরাদ্দের কার্যক্রম স্থগিত রেখেছেন। ফলে এগুলো নিষ্পত্তি না হলে প্রকল্প এগোবে না।'
টাকা দিলেই কেবল দ্রুত কাজ হয়
নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, 'রাজউক গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। যার কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া। কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠানটি সেবা না দিয়ে নানাভাবে রাজধানী ও পাশ্ববর্তী এলাকার অনেক মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলেছে বলে অভিযোগ আছে।'
তিনি বলেন, 'তাদের একটি অভিযোগ শাখা আছে; সেটিও অকার্যকর। এছাড়াও নানা বিভাগে যারা দায়িত্বে রয়েছেন, তারা লেনদেন ছাড়া কোনো কাজ করেন না। যেসব কাজে তাদের স্বার্থ থাকে না, সেসব কাজে তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে। এ কারণেই আদালতের আশ্রয় নিচ্ছেন ভুক্তভোগী নাগরিকরা।'
বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভবন নির্মাণের নকশা অনুমোদনে অনিয়মের অভিযোগ করে রাজউকের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে আরও বেশি সংখ্যক ভুক্তভোগী।
আদালত সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভবনের নকশার অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে অনুমোদন না পেয়ে হাইকোর্টে রিট রয়েছে প্রায় ১,১০০টি।
রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকায় পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ৭ কাঠা জমির ওপর একটি ছয় তলা ভবন নির্মানের জন্য রাজউকের কাছে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে নকশা জমা দিয়েছিলেন রেজাউস সামাদ।
তিনি বলেন, 'ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী যথাযথ নকশা প্রণয়ন করে জমা দিলেও রাজউকের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে অনুমোদন পাইনি। তারা অতিরিক্ত টাকা ছাড়া অনুমোদন দেবেন না বলে জানিয়েছেন। ফলে গত বছরের মাঝামাঝি হাইকোর্টে রিট দায়ের করতে বাধ্য হয়েছি। আদালত রুল জারি করলেও এখন পর্যন্ত রাজউকের পক্ষ থেকে জবাব না দেওয়ায় শুনানি হচ্ছে না।'
নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, 'নকশা অনুমোদনে ঘুষ লেনদেন একটি ওপেন সিক্রেট। রাজউকের সংশ্লিষ্ট শাখাকে খুশি করতে পারলে অবৈধ নকশাও অনুমোদন নেওয়া যায়। শুধু নকশার ক্ষেত্রেই নয়, রাজউকের প্রকল্পগুলোর জন্য যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের যথাযথ পাওনা এবং ক্ষতিপূরণ অনেকেই পায়নি।'
শুধু নকশার ক্ষেত্রেই নয়, রাজ্উকের প্রকল্পগুলোর জন্য যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, তাদের যথাযথ পাওনা এবং ক্ষতিপূরণ অনেকেই পায়নি বলে উল্লেখ করেন ইকবাল হাবিব।
রাজউক ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত প্রায় ৮০টি রিট রয়েছে রাজউকের বিরুদ্ধে।
সমাধান কী?
নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সালাউদ্দিন যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন উন্নত দেশের অনুকরণে একটি প্ল্যানিং ইন্সপেক্টোরেট তৈরির পরামর্শ দেন।
এর কার্যক্রম ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, 'এটিও এক ধরনের আদালত, তবে বিচারিক আদালতের মতো নয়। মৌলিক পার্থক্য হচ্ছে, এখানকার বিচারকরা সরকার দ্বারা নির্বাচিত অভিজ্ঞ পরিকল্পনাবিদ। এখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোনো আপিলের সমাধান করতে হয়।'
'বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর গঠন অন্যরকম হতেই পারে, তবে এই সংস্থাটি সব উন্নয়ন সংস্থা ও পৌরসভার প্ল্যানিং সেলকে এক ছাতার আওতায় নিয়ে আসতে পারে,' যোগ করেন তিনি।
স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, 'পুরোনো মামলাগুলো কীভাবে দ্রুত সমাধান করো যায়, তা নিয়ে রাজউককেই ভাবতে হবে। প্রয়োজনে হাই কোর্টের একটি নির্ধারিত বেঞ্চে নির্দিষ্ট সময়ে এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য রাজউক প্রধান বিচারপতির কাছে আবেদন করতে পারে।'
তিনি বলেন, 'এসব মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে শুধু বিচারপ্রার্থীদেরই খরচ ও হয়রানি হচ্ছে না, রাজউকেরও খরচ হচ্ছে। যেটা সরকারের টাকা। রাজউকের অবহেলার কারণেই অযথা জনগণের অর্থের অপচয় হচ্ছে।'
রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, রাজউকের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, সেগুলো তদারকি করার জন্য একটি শাখা এবং একটি আইনজীবী প্যানেল রয়েছে।
তিনি বলেন, 'রাজউকের বিরুদ্ধে যেসব মামলা রয়েছে, তার বেশিরভাগেই আরো বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বিভাগ জড়িত। এছাড়া অনেক ব্যক্তিও রয়েছেন বিবাদী হিসেবে। ফলে এসব রিট বা মামলা নিষ্পত্তিতে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে ইতোমধ্যেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।'
'অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের সহায়তা নিয়ে এসব মামলা কীভাবে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সেই সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে,' যোগ করেন রাজউক চেয়ারম্যান।