যেভাবে বদলে গেল শাবি আন্দোলনের গতিপথ
টানা সাত দিনের অনশন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন অনশনকারী শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই। ২৮ জনের মধ্যে ১৯ জনকেই ভর্তি করা হয়েছিল হাসপাতালে। দ্রুত অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। এতে বাড়ছিল- শঙ্কা আর উদ্বেগ।
সহযোদ্ধাদের শরীরের এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থা দেখে মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় অনশনের কর্মসূচি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নেন একপক্ষ। তবে অপরপক্ষ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড়। এনিয়ে রীতিমত মতবিরোধ দেখা দেয় উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনকারী সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
রাতপর্যন্ত যখন এসব নিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি চলছিল তখনই খবর আসে ঢাকা থেকে ক্যাম্পাসে আসছেন অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হক। দুজনই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। তারা ক্যম্পাসে আসছেন এই খবর জানাজানি হওয়ার পর মঙ্গলবার প্রায় পুরো রাত তাদের অপেক্ষায় কাটে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের।
ভোর ৪টার দিকে ক্যাম্পাসে এসে পৌঁছেন জাফর ইাকবাল ও ইয়াসমিন হক। ক্যাম্পাসে এসেই তারা অনশনতরত শিক্ষার্থীদের কাছে যান। তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। এরপর তিনি অনশনকারীদের বলেন, 'সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আমার সাথে কথা বলা হয়েছে। তারা তোমাদের সব দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। তাছাড়া, তোমাদের জীবন খুবই মূল্যবান। একজন মানুষের জন্য তোমাদের জীবন নষ্ট করতে পারো না। তোমরা অনশন ভাঙো প্লিজ।'
জাফর ইকবালের আহ্বানে অনশনকারীরা প্রথমে রাজি না হলেও প্রায় দুই ঘন্টা তাদের বুঝান তিনি। পরে বুধবার (২৬ জানুয়ারি) ভোর ৬টার দিকে অনশন ভাঙতে সম্মত হন তারা। সিদ্ধান্ত হয়, হাসপাতালে যেসব অনশনকারী আছেন তাদের ক্যাম্পাসে নিয়ে এসে একসাথে অনশন ভাঙবেন সবাই।
এরপর সকাল ১০টার দিকে হাসপাতাল থেকে ক্যাম্পাসে আনা হয় অনশনকারী ১৯ শিক্ষার্থীকে। ১০টা ২০ মিনিটে এক শিক্ষার্থীকে পানি পান করিয়ে অনশন ভাঙান জাফর ইকবাল ও ইয়াসমিন। এরপর একে একে অনশনকারী ২৮ শিক্ষার্থীর অনশন ভাঙান। অবসান হয় শিক্ষার্থীদের টানা ১৬৩ ঘন্টার অনশনের। তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সৃষ্টি হওয়া উদ্বেগেরও অবসান হয়।
আন্দোলন চলবে:
অনশন কর্মসূচি থেকে সরে এলেও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে চান শাবি শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে বুধবার রাতেই তারা পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করবেন বলে জানা গেছে।
অনশন ভেঙে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম অপূর্ব বলেন, 'অধ্যাপক জাফর ইকবাল আমাদের কাছে খুব সম্মানিত। আমরা তাকে বিশ্বাস করি। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, আমাদের দাবি পূরণের ব্যাপারে সরকারের উচ্চমহল থেকে তাকে আশ্বাস দিয়েছে। আশা করছি, সরকার তাকে দেয়া এই আশ্বাস রাখবে।'
অপূর্ব বলেন, 'অনশন থেকে সরে এলেও আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। উপাচার্যের পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে। দ্রুতই নিজেরা বসে আমরা আন্দোলনের ধরন ও কর্মসূচি ঠিক করব।'
আন্দোলনকারীদের অন্যতম মুখপাত্র মোহাইমিনুল বাশার রাজ বুধবার সন্ধ্যায় বলেন, আমরা রাতে নিজেদের মধ্যে বসে আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণ করব।
তিনি বলেন, উপাচার্য ভবনের অবরোধ এখনও আমরা প্রত্যাহার করিনি। তিনি বাসা থেকে বের হতে হলে পদত্যাগ করেই বের হতে হবে।
'তাকে আমি দানব বলি'
অনশন ভাঙ্গানোর পর শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে কথা বলে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এসময় তিনি বলেন, 'আমি যতটা চিন্তা করেছিলাম অনশনকারীদের শারীরিক অবস্থা তার চেয়েও খারাপ। তাদের শরীরে স্যালাইনও পুশ করা যাচ্ছে না। বেশিরভাগই বসতে পারছে না। যে মানুষ এই অবস্থা দেখার পরও নিজের জায়গায় অনড় থাকে, তাকে আমি মানুষ বলতে চাই না। আমি তাকে দানব বলি।'
জাফর ইকবাল বলেন, 'আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে যতগুলো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সবগুলো অমানবিক, নিষ্ঠুর ও দানবীয়। আমি ধরেই নিয়েছিলাম এখানে একটি মেডিকেল টিম থাকবে। কিন্তু এখানে কোনো মেডিকেল টিম নেই। শুধু তাই নয়, যারা তাদের টাকাপয়সা দিয়ে সহযোগিতা করেছিল, তাদের গ্রেপ্তার করে মামলা দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে নিন্দনীয় আর কিছু নেই। আমি আশা করব, এই বিষয়গুলো যেন অবশ্যই বন্ধ হয়। আমাদের ছেলেমেয়েদের যেন মুক্ত করে দেয়া হয়।'
তিনি বলেন, 'আমি এখানে আসার আগে সরকারের উচ্চমহলের সঙ্গে কথা বলে এসেছি। আমি আশা করি, তারা আমাকে যে কথা দিয়েছেন সে কথাগুলো রাখবেন। যদি তারা তা না রাখেন তবে কেবল আমার সঙ্গে নয়, এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হবে।'
এই শিক্ষাবিদ বলেন, 'আমাদের শিক্ষার্থীরা যে সুন্দর আন্দোলন করেছে তা দেশের কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারবে না। এই আন্দোলনে দেশের সব তরুণ-তরুণী হৃদয় থেকে সমর্থন দিয়েছে। তাদের আন্দোলন থেকে কাউকে ফায়দা নেয়ার সুযোগ দেয়নি। নিজেরাই সহযোদ্ধাদের হাসপাতালে নিয়ে গেছে, খাবার রান্না করেছে। সব তারা করেছে। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য খুব কমই আছে।'
শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলাকে অত্যন্ত নৃশংস দাবি করে তিনি বলেন, 'পুলিশ কেন নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালাবে? ক্যাম্পাসে পুলিশ যুদ্ধসাজে ঢুকবেই কেন? পুলিশের হামলার সময় শিক্ষকদের নীরব ভূমিকারও সমালোচনা করেন তিনি।
এদিকে এর আগে শিক্ষামন্ত্রীর সাথে শিক্ষার্থীদের বৈঠকে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্কটের সুরাহা হয়নি। নতুন করে উভয়পক্ষের বৈঠকের কথা বলা হলেও তা আর হয়নি। ফলে এই সঙ্কটের সমাধান কোনপথে এই নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
শনিবার রাতে শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের সাথে বৈঠক করেন শিকামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। এতে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষার্থীদের অনশন ভেঙ্গে আলোচনায় আসার আহ্বান জানান। আর শিক্ষার্থীরা জানান, উপাচার্যের পদত্যাগ ছাড়া অনশন ভাঙ্গবেন না। ফলে কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় বৈঠক।
রোববার দুপুরে আবারও দুইপক্ষের বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা আর হয়নি। এদিকে উপাচার্যের পদত্যাগ ইস্যুতে দুইপক্ষ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা এই দাবিতে অনমনীয় আর শিক্ষা উপমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাদের এই দাবি অযৌক্তিক। এই বিপরীতমূখী অবস্থানের কারণে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে এসেছে।
শিক্ষা উপমন্ত্রীর কথার প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা বলেন, আমাদের তিন দফা দাবির আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়, লাঠিচার্জ করে। এর পরে আমরা এই উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করছি। যে গুলি চালাতে পারে, তাকে আমরা চাই না। এটা আমাদের যৌক্তিক দাবি। এই দাবিতে আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন ও আমরণ অনশন করছে। তারা হাসপাতালে ভর্তি। এই পরিস্থিতিতে আমাদের মনে হচ্ছে, আমাদের প্রাণের চেয়ে ওই একটা চেয়ারের দাম বেশি। আমরা সেই পথে যাচ্ছি, আমাদের গণঅনশনে এখন অনেকেই যোগ দিচ্ছেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী সাব্বির আহমদ বলেন, 'আমরা আলোচনা চাই। তবে আমাদের একটাই দাবি উপাচার্যের পদতাগ। এই দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস চাই।'
এদিকে, রোববার রাত থেকে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের বাসভবনে বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন শিক্ষার্থীরা। সোমবার বিকল্প ব্যবস্থায় তার বাসায় বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সোমবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আলমগীর কবীরের নেতৃত্বে কয়েকজন শিক্ষক্ষ খাবার নিয়ে এসে উপাচার্যের বাসভবনে প্রবেশ করতে চাইলেও শিক্ষার্থীরা তাদের প্রবেশ করতে দেননি।
এসময় প্রক্টর আলমগীর কবীর বলেন, উপাচার্য বিদ্যুৎ ও পানিবিহীন অবস্থায় আছেন, তিনি অসুস্থ। আমরা মানবিক দায়িত্ব থেকে তার সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। শিক্ষার্থীদের জন্যও আমরা খাবার নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থীরা আমাদের অনুরোধ রাখেনি। ফলে আমরা ভেতরে ঢুকেতে পারিনি।
আন্দোলন শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল বাশার বলেন, 'আমরা এতদিন ধরে অনশন করছি, অনেকে মৃত্যুপথযাত্রী, অথচ স্যারেরা আমাদের কথা না ভেবে উপাচার্যের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। এতে বোঝা যায় শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের কোন দরদ নেই।'
সোমবার বিকেলে ক্যাম্পাসে মিছিল করে শিক্ষার্থীরা। এছাড়া সন্ধ্যা থেকে রোড পেন্টিং করে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিনের পদত্যাগের দাবি জানানো হচ্ছে। এছাড়া উপাচার্য ভবনের সামনে চলছে অনশন।
জামিনের অপক্ষায় সাবেক ৫ শিক্ষার্থী:
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অর্থ জোগান দেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারকৃত বিশ্ববিদ্যালয়টির সাবেক ৫ শিক্ষার্থীর জামিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ বুধবার বিকেলে শুনানি শেষে সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আদালতের আদেশের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে প্রশাসন।
গ্রেপ্তারকৃত ৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে নাজমুস সাকিব নামে একজনের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়েছে। বুধবার বিকেলে তাকে সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর বাকি চারজনকে বিকেলে জামিন শুনানির জন্য সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট-২ আদালতের বিচারক মোঃ সুমন ভূঁইয়ার আদালতে প্রেরণ করা হয়।
বিকেলে তাদের জামিন শুনানির পর সন্ধ্যা পর্যন্ত বিচারক কোনো আদেশ দেননি বলে জানান সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান। তবে রাতের মধ্যেই তাদের জামিন আদেশ আসতে পারে বলে আশা তার।
সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার আশরাফ উল্যাহ তাহের জানান, 'গ্রেপ্তার ৫ জনের মধ্যে নাজমুস সাকিব করোনা শনাক্ত হওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি মামলার ৩ নম্বর আসামী।'
এরআগে গত সোমবার ও মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এ ৫ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একটি দল। পরে মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) বিকেলে তাদের সিলেট নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এদিন রাতেই তাদের নামে মামলা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন- টাঙ্গাইল জেলার সখিপুর দারিপাকা গ্রামের মতিয়ার রহমান খানের ছেলে হাবিবুর রহমান খান (২৬), বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানাধীন লক্ষ্মীকোলা গ্রামের মুইন উদ্দিনের ছেলে রেজা নুর মুইন (৩১), খুলনা জেলার সোনাডাঙ্গার মিজানুর রহমানের ছেলে এএফএম নাজমুল সাকিব (৩২), ঢাকা মিরপুরের মাজার রোডের জব্বার হাউসিং বি-ব্লকের ১৭/৩ বাসার এ কে এম মোশাররফের ছেলে এ কে এম মারুফ হোসেন (২৭) ও কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর থানাধীন নিয়ামতপুর গ্রামের সাদিকুল ইসলামের ছেলে ফয়সল আহমেদ (২৭)।