কমিউনিটি ট্যুরিজম: পথ দেখাচ্ছে দার্জিলিং পাড়া
সবুজ বনভূমি, ঢেউ খেলানো মেঘ-পাহাড় এবং প্রাণবৈচিত্র্যের সম্ভার নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম। ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতি, ভিন্নরকম জীবনধারা ও নানারকম খাদ্যাভ্যাস মিলে ছড়িয়ে রয়েছে জাতিগতবৈচিত্র্য। রয়েছে পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়ি ঝিরি, ঝরণাও।
ঢেউ খেলানো এই মেঘ-পাহাড়ে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বর্ণাঢ্য সংস্কৃতি ও জাতিগতবৈচিত্র্যের টানেই সেখানে বারবার ছুটে যান ভ্রমণপ্রিয় পর্যটকেরা। একমাত্র বর্ষাকাল ছাড়া বছরের অধিকাংশ সময় পর্যটকমুখর হয়ে থাকে পার্বত্য জেলা বান্দরবান। পর্যটকেরা জেলা শহরে সাজানো পর্যটন কেন্দ্র বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন নানা জাতিগোষ্ঠীর পাড়া বা এলাকায়।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার বম জনগোষ্ঠীর এলাকা দার্জিলিং পাড়া ক্রমশ পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তুলনামূলক কম মূল্যে থাকা-খাওয়া যায় সেখানে। পর্যটকদের থাকার জন্য বাঁশ ও কাঠের তৈরি কটেজ ও ছোট ছোট টংঘর গড়ে তোলা হয়েছে। এসব পাড়ায় থাকলে একদিকে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হতে পারেন, অন্যদিকে পাহাড়ে গ্রামীণ পরিবেশে প্রাণ-প্রকৃতিকে উপভোগ করার সুযোগ হয় তাদের।
রুমা উপজেলার দার্জিলিং বম পাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বেড়াতে এসেছেন পর্যটকেরা। কেউ চাকরিজীবী দল, আবার কোন কোন দল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। বগা লেক থেকে দার্জিলিং পাড়া পর্যন্ত কেউ এসেছেন ১৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে। কেউবা এসেছেন গাড়িতে করে।
ঢাকা থেকে আসা চার পরিবার মিলে পনেরজনের দলের সদস্য শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, দলের সবারই বান্দরবানে প্রথম আসা। তাও একেবারে দুর্গম কেওক্রাডং পাহাড়ের মত জায়গায়।
''বেশিরভাগ পর্যটক শুধু আলোচিত ও জনপ্রিয় কতগুলো জায়গা চেনে ও সেখানে বেড়াতে যায়। কিন্তু পাহাড়ে এলে অন্যরকম অনুভূতি পাওয়া যায়, এটা অনেকেই জানে না। পাহাড়ে এলেই বোঝা যায়, সবকিছু মিলে আমাদের দেশটা কত সুন্দর।''
তবে কটেজে থাকা ও খাওয়ার দাম সন্তোষজনক হলেও মানের দিক থেকে আরেকটু উন্নততর হলে অনেক বেশি পর্যটক বেড়াতে আসতে আকৃষ্ট হবে বলে মনে করেন তিনি।
একই দলের সদস্য ফারজানা ইসলাম বলেন, পাহাড় ও প্রকৃতি দেখার আগ্রহ থেকেই পরিবার নিয়ে তারা দার্জিলিং পাড়া ও কেওক্রাডং পাহাড়ে এসেছেন। হাঁটার অভ্যাস না থাকায় গাড়িতে করে আসা হয়েছে। ছেলেমেয়েরাও পাহাড়ে এসে অনেক কিছুর সাথে পরিচিত হচ্ছে। তবে এত দুর্গম এলাকায় কম বয়সী ছেলেমেয়েকে নিয়ে আসা একটু ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছে তার কাছে।
পেশায় চিকিৎসক, যশোর নিবাসী হাসান জানান, তার ছয়জনের দলটি আগে থানচির রেমাক্রি ও নাফাকুম জলপ্রপাতে ঘুরেছে। এবার কেওক্রাডং পাহাড়ে এসে দার্জিলিং পাড়ার একটা কটেজে উঠেছেন।
তিনি বলেন, পাহাড় ভ্রমণে আসলে পাহাড়ি পরিবেশটাই ভাল লাগে। শহুরে পরিবেশের মত চাকচিক্য থাকলে হয় না। এজন্য দ্বিতীয়বারের মত ঘুরতে এসেও পাহাড়ের গ্রামীণ পরিবেশকে বেছে নিয়েছেন তারা।
শুধু প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়, পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়েও সবার জন্য দার্জিলিং পাড়া একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে বলে মনে করেন দলের আরেক পর্যটক মোজাম্মেল হক।
মোজাম্মেল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, "পাহাড় মানেই সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং ঝিরি-ঝরণা বুঝতাম। কিন্তু পাহাড়ের ভেতর আদিবাসীদের পাড়াগুলোও এত সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো হয় তা জানতাম না।"
বগালেক থেকে ১৩ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে এসেছেন জানিয়ে একই দলের আরেক পর্যটক ইস্রাফিল বলেন, "পথে পথে হেঁটে এসে বোঝার চেষ্টা করেছি, স্থানীয় লোকজন কতোটা কষ্ট সহ্য করে এখানে টিকে আছে। বিশেষ করে মাথায় বোঝা বহন করে নারীদের পাহাড় থেকে পাহাড়ে হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য খুব অবাক করেছে সবাইকে।"
দার্জিলিং পাড়ায় বেড়াতে আসা পর্যটকদের মত, সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের মুহুর্ত এ পাড়ার সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য। ভোরে সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার সুযোগ না হলে এখানে আসাই বৃথা হবে। কেওক্রাডং পাহাড় ভেদ করে যখন সূর্য উদিত হয়, তখন যেন পাহাড়ের আসল সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।
বান্দরবান জেলা শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার দূরে রুমা উপজেলা। বেড়াতে আসা পর্যটকরা প্রথমে রুমা সদর থেকে খোলা জিপ অথবা ল্যান্ড ক্রুজারে করে বগালেক পর্যন্ত চলে যায়। তবে অভিযানপ্রিয় পর্যটকদের অনেকেই বগালেক থেকে কেওক্রাডং পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পাহাড়ি পথ পায়ে হেঁটে রওনা দেয়।
কেওক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশেই রয়েছে দার্জিলিং পাড়া। অধিকাংশ পর্যটক কেওক্রাডং পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে এই দার্জিলিং পাড়ার বিভিন্ন কটেজেই রাতযাপন করে থাকে।
দার্জিলিং পাড়ার কারবারী সাকসিং বম জানিয়েছেন, ১৯৬৫ সালে স্থাপন করা এ পাড়ায় মোট ৩৫টি বম সম্প্রদায়ের পরিবার রয়েছে। পাড়ার প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিন যার যার ঘরের আঙ্গিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখার নিয়ম রয়েছে। কোন ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র পড়ে থাকার সুযোগ নেই। অপ্রয়োজনীয় কাগজ ও প্যাকেট ফেলার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাতে ডাস্টবিন ও ঝুড়ি রয়েছে।
পাড়া পরিচ্ছন্ন রাখতে সবাইকে নিয়ে মাসে দু'বার করে সভা করা হয় বলে জানান তিনি।
দার্জিলিং পাড়ার ক্লাউড হিল রিসোর্ট এন্ড এগ্রো কমপ্লেক্সের কর্ণধার জোভিয়াল বম মেঘলা জানান, "কেওক্রাডং পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকদের আবাসন সুবিধার জন্য দার্জিলিং পাড়ায় কটেজ ও ছোট টংঘর গড়ে তুলেছেন তারা। সেখানে সব মিলে ৩০০ জন পর্যটকের থাকার সুবিধা রয়েছে।"
মেঘলা বলেন, ''আমার কটেজ ও ছোট টংঘরে ১৫০ জনের মত পর্যটক থাকার সুযোগ রয়েছে। বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার এই তিন দিন পর্যটকের সমাগম ঘটে। এছাড়া ইংরেজি নববর্ষ ও ঈদের সময় আবাসনের সংকট পড়ে যায়। তখন খোলা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে পর্যটকরা রাত কাটায়।''
লালরাম জো বম নামে কটেজের এক মালিক বলেন, পর্যটকদের কাছ থেকে কক্ষ হিসেবে নয়, মাথাপিছু প্রতিরাতে ২৫০ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হয়। দোকানে বাংলা খাবারের পাশপাশি স্থানীয় নানা খাবারের অর্ডার নেওয়া হয়।
কোন সময় একটানা তিনদিনের ছুটির থাকলে শুধুমাত্র দার্জিলিং পাড়ায় একদিনে চার শতাধিক পর্যটকের আগমন ঘটে বলে জানান রুমা পর্যটক গাইড সমিতির সহ-সভাপতি সাপুল বড়ুয়া।
রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন শিবলি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, স্থানীয়রা নিজেদের উদ্যোগেই সেখানকার ঐতিহ্য বজায় রেখে ছোট ছোট কটেজ গড়ে তুলেছেন। বেড়াতে আসা পর্যটকদের এগুলো আকৃষ্ট করে।
এখন থেকে রুমা উপজেলায় মাসিক গড়ে কী পরিমাণ পর্যটক বেড়াতে যায় তা নিবন্ধন করে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।