অতীত রেকর্ড খারাপ হওয়া সত্ত্বেও ওসি প্রদীপকে পুলিশের পদক প্রদান করায় পদকের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে: আদালত
টেকনাফ থানার ওসি থাকাকালে আসামি প্রদীপ কুমার দাশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ২০৪ জন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল রায়ে বলেন, একজন অপরাধী যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, তার বিচারপ্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে জাতির জনক বাঙালি জাতিকে যে সংবিধান উপহার দিয়েছেন, সেই সংবিধানে আইনের শাসন এবং প্রত্যেক মানুষের বিচারপ্রাপ্তির সাংবিধানিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। অথচ ওসি প্রদীপ কুমার দাশের মতো পুলিশ অফিসার আইনের রক্ষকের রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে আইনের শাসন ও সংবিধানকে অবজ্ঞা প্রদর্শন করায় কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে ধারাবাহিকভাবে বিপুল সংখ্যক লোক তার হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
২৮৮ পৃষ্ঠার রায়ে ওসি প্রদীপের বিপিএম-পিপিএম পদক নিয়ে সমালোচনা করে বিচারক আরও বলেন, তার অতীত রেকর্ড খারাপ হওয়া সত্ত্বেও তাকে একাধিকবার বিপিএম, পিপিএম পদকে ভূষিত করায় উক্ত পদকের মর্যাদাকে ভূলুন্ঠিত করা হয়েছে।
আসামি প্রদীপ কুমার দাশ বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়াদের ডাকাত, মাদক ব্যবসায়ী, মানব পাচারকারী হিসেবে অপরাধী সাব্যস্ত করে হত্যা করে ক্রসফায়ারের নাটক সাজিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেক হত্যাকাণ্ডের শিকার ভিকটিম/ভিকটিমদের নিকটাত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশীসহ ৩০-৪০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা, একটি মাদক এবং একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করতেন।
এই মামলার নিহত মেজর (অবঃ) সিনহা মোঃ রাশেদ খান ওসি প্রদীপ কুমার দাশের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ২০৫তম শিকার।
রায়ে বলা হয়েছে, এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তিতর্ক শুনানীকালে ১০৪ জন ভিকটিমের সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা দাখিল করেন, যারা ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের শিকার। সময়স্বল্পতার কারণে অবশিষ্টদের সুনির্দিষ্ট নাম-ঠিকানা উপস্থাপন করা যায়নি।
এতে দেখা যায়, ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বহুদিন ধরে পরিকল্পিত, ষড়যন্ত্রমূলক ও উদ্দেশ্যমূলকভাবে সাজানো ঘটনার অবতারণা করে যখন যাকে ইচ্ছা খুন করার মানসিকতা ও প্রবণতা লালন করে আসছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী উল্লেখ করেছেন, আসামি ওসি প্রদীপ কুমার দাশ মেজর (অবঃ) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যা মামলায় আটক না থাকলে এতদিনে তিনি ও তার অনুচরদের হাতে আরো বহু লোক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন।
তিনি বলেন, "এই আসামি প্রদীপ এমনই এক প্রদীপ, যার নিচে শুধুই অন্ধকার।"
যে কারণে ছয় পুলিশ সদস্যকে খালাস
এই আসামিগণ নিজেরা সহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারা মতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী আসামিগণ বা সাক্ষীগণের জবানবন্দি পর্যালোচনায়, তাদের ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে এই আসামিগণ অত্র মামলার ঘটনা সম্পর্কিত ষড়যন্ত্র ও পূর্ব পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত ছিল কিংবা ঘটনা সংঘটনকালে স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে কোন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে কিংবা কোন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেছে মর্মে কোন বক্তব্য পাওয়া যায় না।
অন্য কথায়, এই অভিযুক্তরা তাদের ডিউটিরত চেকপোস্টে অবৈধভাবে কর্তৃত্ব গ্রহণকারী সশস্ত্র, মারমুখী ও অগ্নিশর্মা ইন্সপেক্টর মোঃ লিয়াকত আলীর নির্দেশ পালন করতে বাধ্য হয়েছেন শুধু।
এটা প্রমাণিত হয়নি যে, তারা স্বেচ্ছায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়েছিল। তাই এ মামলায় এসব আসামিকে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে রায়ে বলা হয়েছে।
শিপ্রার সাক্ষ্য না নেয়া নিয়ে আদালতের বক্তব্য
যুক্তিতর্ক শুনানিকালে আসামিপক্ষ দাবি করেছেন অভিযোগপত্রের ৮৩ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৬৫ জন সাক্ষীকে আদালতে সাক্ষ্য প্রদান করার জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। সাক্ষী শিপ্রা দেবনাথ, লাশ বহনকারী গাড়ীর ড্রাইভার ও সহকারীসহ অভিযোগপত্রের বাকী সাক্ষীদের আদালতে না আনার কারণে আসামিগণ খালাস পাওয়ার হকদার। এই মামলার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীসহ সিনহা হত্যার অপরাধ ও মোটিভ প্রমাণের জন্য যারা অতি প্রয়োজনীয় সাক্ষী ছিলেন তাদের সবাইকে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিপ্রা দেবনাথ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী নন ও তাকে বাদীর এজাহারেও সাক্ষীদের তালিকায় রাখা হয় নি।