‘নিজ কুকীর্তি ঢাকতেই মেজর সিনহাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ওসি প্রদীপ’
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযানের আড়ালে নানান অপকর্মের তথ্যবহুল সংবাদ পরিবেশন করায় ওসি প্রদীপ মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে রিমান্ডের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। পাশাপাশি ইচ্ছেমতো যাকে ইচ্ছে ধরে নিয়ে 'ক্রসফায়ারের' ভয় দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতানোর পরও, অনেককে নির্বিচারে হত্যা করেছে।
সিনহা হত্যা মামলার ১৮তম সাক্ষী সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খান বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) আদালতে এমন সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন মামলা সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনজীবী।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রমের চতুর্থ দফার দ্বিতীয় দিনে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইলের আদালতে এ সাক্ষ্য দেন তিনি। তিনি ছাড়াও বুধবার টেকনাফ হোয়াইক্যংয়ের সালেহ আহমদ ও বেবী বেগমের সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন আদালত।
এর আগে বুধবার সকাল ১০ টায় সিনহা হত্যা মামলার সাক্ষী টেকনাফ সদরের সাবেক ইউপি সদস্য হামজালালের মুলতবি জেরা শুরুর মধ্য দিয়ে আদালতের বিচার কাজ শুরু হয়। ২০ তম সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা সম্পন্ন করে আগামী ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর পরবর্তী সাক্ষ্যের দিন ধার্য্য করে সন্ধ্যা ৭টায় আদালত মুলতবি ঘোষণা করেন।
সাক্ষী সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফা খানের বরাত দিয়ে আদালতে উপস্থিত আইনজীবিরা জানিয়েছেন, ২০১৯ সালের ২৪ জুন থেকে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন অনলাইনে মাদক ও ওসি প্রদীপের নানা অপকান্ড নিয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন তিনি। সেসব সংবাদে ওসি প্রদীপের অনেক কুকীর্তির কথা উঠে আসে।
এতে ওসি প্রদীপ ক্ষিপ্ত হয়ে সাংবাদিক ফরিদকে মিথ্যা মামলায় জড়ানোসহ প্রাণনাশের হুমকি দেয়। ওসি প্রদীপের হুমকিতে সাংবাদিক ফরিদ ভয় পেয়ে ঢাকা শহরে আত্নগোপন করে। কিন্তু সেখান থেকে ওসি প্রদীপ কথিত কিছু সিআইডি সদস্যের সহযোগিতায় তাকে আটক করে টেকনাফ নিয়ে যায়। পরে ওসি প্রদীপ তাকে শারীরিকভাবে অমানবিক নির্যাতন করে। মারার এক পর্যায়ে চোখে মরিচের গুঁড়ো দেয়।
এরপর তাকে নিয়ে কক্সবাজার শহরের কুতুবদিয়া পাড়ায় ফরিদের বাসায় অভিযানের নাটক চালায়। পরে ৪ হাজার ইয়াবা, একটি নতুন এলজি ও কার্তুজসহ আটক দেখানো হয়। ওই মামলায় রিমান্ডের নামে ওসি প্রদীপ বাহিনী ফরিদকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালায়। পরে মেজর সিনহা কক্সবাজার এসে ফরিদুল মোস্তফা খানের সাথে কারাগারে দেখা করার পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু বিষয়টি জেনে যায় ওসি প্রদীপ। তার অপকর্মের কথা যেন মেজর সিনহা জানতে না পারে এবং ডকুমেন্টরি তৈরি করতে না পারে- সেজন্য তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে ওসি প্রদীপ বাহিনী।
সিনহা হত্যা মামলার বিচার কাজের সাথে যুক্ত একাধিক আইনজীবি আরো জানিয়েছেন, ফরিদুল মোস্তফা খানের বিরুদ্ধে ওসি প্রদীপের সহযোগীরা ৫টি মামলা দায়ের করে। সেসব মামলায় ১১ মাস ৫ দিন কারাভোগ করে বের হয়ে প্রদীপের বিরুদ্ধে ফরিদুল মোস্তফা খান মামলা দায়ের করেছেন।
আদালতের আইনজীবিরা সাক্ষী মো. সালেহ আহমদ ও বেবী বেগমের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, গৃহবধূ বেবী বেগমের স্বামী ও দিনমজুর মো.সালেহ আহমদের এক স্বজনকে প্রথমে আটক ও পরে মুক্তির কথা বলে টাকা নিয়েও, ক্রসফায়ারের নামে খুন করেছে ওসি প্রদীপ বাহিনী। তারা দুজনেও আদালতে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, বুধবার চতুর্থ দফা পর্যন্ত সিনহা হত্যা মামলায় ২০জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। এদিন সাক্ষ্যদানকারীরা সিনহাকে হত্যার সম্ভাব্য কারণ জানিয়েছেন ।
পিপি আরো বলেন, সিনহা হত্যা মামলার পঞ্চম দফার সাক্ষী শুনানির জন্য আগামী ১০, ১১ ও ১২ অক্টোবর দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এর আগে বুধবার সকাল পৌনে ১০টায় কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে মামলার ১৫ আসামি- বরখাস্ত হওয়া ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলী, কনস্টেল রুবেল শর্মা, এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া ও কনস্টেবল সাগর দেব নাথ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজিব ও মো. আব্দুল্লাহ এবং টেকনাফের বাহারছড়ার মারিশবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও পুলিশের করা মামলার সাক্ষী নুরল আমিন, মো. নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিনকে কড়া পুলিশি পাহারায় আদালতে আনা হয়।