বাংলাদেশ নার্স রপ্তানি করতে চাইলেও, যত শিগগির সম্ভব বিদেশি নার্স চাইছে
সংজ্ঞা অনুসারে, নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটের (আইসিইউ) শয্যা গুরুতর অসুস্থ এবং অস্থিতিশীল অবস্থার রোগীর জন্য নির্দিষ্ট। তবে হাসপাতালের অন্যান্য সাধারণ আইসিইউ থেকে এ প্রতিবেদনে আলোচিত পাঁচটি শয্যার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা হল যত্নপ্রাপক রোগীরা - নবজাতক এবং শিশু- যাদের কার্ডিয়াক সার্জারি শেষে সেখানে রাখা হয়।
তাদের থাকে মৃত্যুর ঝুঁকি, প্রাণ বাঁচাতেই তাদের আইসিইউ'তে রাখা দরকার।
২০২১ সালের জুলাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি সার্জনদের মাধ্যমে শিশুদের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা সেবাদান চালু করা হলেও এখন দেখা দিয়েছে বিশেষায়িত দক্ষ নার্সের প্রয়োজনীয়তা। এজন্য গত বছরের নভেম্বরে বিদেশি পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল আইসিইউ নার্স চেয়ে বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে বিএসএমএমইউ। কারণ, দেশের নার্সিং কলেজগুলো এ ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন চিকিৎসা সেবাদানকারী তৈরি করতে পারছে না।
এদিকে স্বাস্থ্য কর্মী রপ্তানির বিষয়ে সরকারের প্রচেষ্টা চলমান থাকার সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি এ নিয়োগ বিজ্ঞাপন পুনঃপ্রকাশ করতে চলেছে। কারণ প্রথমটির সময়সীমা ৩১ ডিসেম্বর ২০২১- এর মধ্যে কোনো নার্সই মেলেনি। নার্সের জন্য বিএসএমএমইউ যোগ্যতা হিসেবে পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল আইসিইউতে ন্যূনতম ২ বছরের সক্রিয় সেবাদানের অভিজ্ঞতা চেয়েছে। বেতন-ভাতা আলোচনা সাপেক্ষ।
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়টির পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়ালজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোঃ জাহিদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিএসএমএমইউ'য়ে আমরা পেডিয়াট্রিক নার্সের সংকটে ভুগছি। যারা আছে তারা শিশুদের মতো বিশেষায়িত হৃদরোগীদের সেবাদানে প্রশিক্ষিত নয়।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজির সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুস সালাম টিবিএসকে বলেন, এ ধরনের আইসিইউ অন্য আইসিইউ থেকে বেশ আলাদা- কারণ এখানকার রোগী শিশুদের বয়স ও ওজন অনেক কম। এসব বাচ্চাদের প্রত্যেককে আলাদা করে যত্ন দিতে হয়।
"বিশেষায়িত প্রশিক্ষণহীন নার্সরা তাদের ধমনী খুঁজে পেতে, ক্যানুলা লাগাতে বা ওষুধের সঠিক ডোজ দিতে সমস্যায় পড়ে, কারণ এখানকার বেশিরভাগ বাচ্চার ওজনই পাঁচ কেজির নিচে"- উল্লেখ করেন তিনি।
এ বাস্তবতায় সঠিক দক্ষতা সম্পন্ন নার্স পেতে হাসপাতালটি এতটাই মরিয়া যে অধ্যাপক জাহিদ বলেছেন, যোগ্য নার্সিং প্রার্থী সঠিক সময়ে উপস্থিত হলে তিনি তাদের সঙ্গেসঙ্গেই নিয়োগ দেবেন।
বিদেশি নার্স নিয়োগের পাশাপাশি, তিনি বলেন যে বিভাগটি বিএসএমএমইউ-তে একটি সম্পূর্ণ পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জারি ইউনিট প্রতিষ্ঠা করার জন্য পেডিয়াট্রিক অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট আনার কথাও বিবেচনা করছে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে একমাত্র এ চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে এখানেই।
এর বাইরে বর্তমানে কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে শিশুদের জন্য সম্পূর্ণ হৃদরোগ চিকিৎসার সুবিধা রয়েছে।
রপ্তানি পরিকল্পনায় মানের ঘাটতি:
চলতি বছরের জানুয়ারিতে সরকার কুয়েতে নার্স ও মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের চাকরির বিজ্ঞাপন দেয়। কর্তৃপক্ষ তখন বলেছিল যে, অন্তত ছয়টি বিদেশি কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ থেকে নার্স নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
তবে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে বাংলাদেশি চিকিৎসক ও নার্সদের দক্ষতা যথেষ্ট দক্ষতা আছে কিনা- বিদেশি নিয়োগকারীরা এখনও সেই সিদ্ধান্তে উপনীত না হওয়ায় তাদের আগ্রহও পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষ বলছেন, নিয়োগকারীদের আগ্রহই তাদের যোগ্যতা ও মানকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছে।
এখন বিএসএমএমইউ বিশেষায়িত বিদেশি নার্স খুঁজছে, এতে দেশের স্বাস্থ্য কর্মী রপ্তানি পরিকল্পনা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। গত মাসে অস্ট্রেলিয়ার সাথে একটি বাণিজ্য বৈঠকের প্রস্তুতির সময়েও দক্ষতার বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসে।
ওই সভার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নার্স রপ্তানিকে এজেন্ডাভূক্ত করতে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনের কাছে চিঠি দেয়।
এজেন্ডার তালিকা পাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ায় নার্স রপ্তানির বিষয়টি এজেন্ডা থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি পাঠিয়েছেন কমার্শিয়াল কাউন্সেলর। তাতে বাংলাদেশের নার্সদের দূর্বলতার চিত্রও ফুটে উঠেছে।
"কারিগরি সক্ষমতা ও উৎকর্ষতার অভাবে বাংলাদেশ এখনও উন্নত বিশ্বে নার্সিং সেবা রপ্তানির পর্যায়ে যেতে পারেনি। ফলে বাংলাদেশের অনেক হাসপাতাল নার্সিং সেবার জন্য আশপাশের দেশের উপর নির্ভর করছে। বিশেষায়িত নার্সিং সেবার জন্য এটি নির্দিষ্টভাবে প্রযোজ্য"- বলে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন হাইকমিশনের কমার্শিয়াল কাউন্সেলর।
বিএসএমএমইউ- এর বিজ্ঞাপনের কথা উল্লেখ করে কাউন্সেলর বলেছেন, দেশের কিছু সরকারি প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নার্সিং কারিকুলামের ত্রুটিগুলো সংশোধন করাসহ, সার্টিফিকেটের স্বীকৃতির জন্য উদ্যোগ এবং ইংরেজিতে আরও দক্ষ গ্রাজুয়েট তৈরির পরামর্শ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের মতে, দেশে ৩৯ হাজারের বেশি আসনসহ ২৭১টি বিএসসি এবং ৫৪৭টি ডিপ্লোমা নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কলেজ (সরকারি ও বেসরকারি) রয়েছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার নার্স চাকরির বাজারে প্রবেশ করে।
গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নার্স ছিলেন ৮০,৭৩৯ জন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার জন সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কাজ করছেন। অন্যরা বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে কর্মরত।
দেশেই কী বিশেষায়িত দক্ষ নার্স তৈরি করা সম্ভব?
শীর্ষ চিকিৎসকরা বলছেন, নার্সিং গ্র্যাজুয়েটরা যাতে দেশের ক্রমবর্ধমান চিকিৎসা খাতের আধুনিকায়নের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে সেজন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ চালু করার এবং পাঠ্যক্রম সংশোধনের উপযুক্ত সময় এসেছে।
অধ্যাপক আব্দুস সালামের মতে, আপাতত শিশু আইসিইউ ও এনআইসিইউতে কাজ করা নার্সদের পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল আইসিউ যন্ত্রপাতি চালানোর ট্রেনিং দিলে এবং যোগ্যতা কিছুটা শিথিল করলে বিদেশ থেকে নার্স আনার প্রয়োজন হবে না।
"তবে দীর্ঘমেয়াদে শিশু হৃদরোগীদের চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত পেডিয়াট্রিক আইসিইউ নার্সিং কোর্স চালু করা। পাশের দেশ ভারতে নিউরো, পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক আইসিইউর জন্য আলাদা প্রশিক্ষিত নার্স আছে"- বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
উল্লেখ্য, দেশে জন্মগত শিশু হৃদরোগী ৬ লাখ। প্রতি বছর ৪০ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মায়। শিশু হৃদরোগী বাড়লেও দেশে চিকিৎসা অপ্রতুল।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নার্সিং ও মিডওয়াইফারি) এনামুল হক বলেন, ঢাকা ও রাজশাহীতে আইসিইউ এর জন্য নার্সদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। মহামারি চলাকালীন প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছিল। তবে নার্সদের জন্য পেডিয়াট্রিক আইসিইউ প্রশিক্ষণ আছে কিনা- তা নিশ্চিত করতে পারেননি তিনি।