অবশেষে মাতারবাড়ি বন্দরের ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা নিরসন, তবে বে টার্মিনালে নতুন জটিলতা
চট্টগ্রাম বন্দরের মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমির শ্রেণি নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা কেটে গেছে। লবন মাঠ হিসেবে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ মূল্য বাবদ অতিরিক্ত আরও ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ টাকা কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে পরিশোধ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।
টাকা পেয়ে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন প্রকল্পের অধিগ্রহণকৃত জমির টাকা বুঝে নিতে গত ৬ ফেব্রুয়ারি জমির মালিকদের নোটিশ দিয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী নোটিশ প্রাপ্তির ১৫ দিন পর শুনানি শেষে টাকা পরিশোধ শুরু করবে জেলা প্রশাসন। ১ জন জমির মালিককে জমির টাকা হস্তান্তর করলে নিয়ম অনুযায়ী যে কোনো সময় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির দখল বুঝিয়ে দিতে পারবে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে জমির শ্রেণি নির্ধারণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে জটিলতা চলছিল তার অবসান হয়েছে। ফলে বন্দর কর্তৃপক্ষ সেখানে দ্রুত বন্দর নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারবে।
তবে মাতারবাড়ি বন্দরের ভূমি অধিগ্রহন জটিলতা কাটলেও বে টার্মিনাল প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের মূল্য নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ওই প্রকল্পে ৮০৩ একর সরকারি খাস জমি প্রতীকী মূল্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরের জন্য গত বছরের জুনে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়।
কিন্তু প্রায় সাত মাস পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে জমির পুরো মূল্য প্রদান করতে হবে। মূল্য বাবদ ১২০ দিনের মধ্যে ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা দাবী করে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। গত ৩০ জানুয়ারি দেওয়া হয় এই চিঠি।
এই প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ৩১ জানুয়ারি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানায় এত টাকা পরিশোধ করা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্ভব নয়।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের শুরুতে প্রকল্প এলাকার ২৮৩ দশমিক ২৭ একর জমি নাল হিসেবে চিহ্নিত করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। সে হিসেবে অধিগ্রহণকৃত জমির মুল্যবাবদ গত বছরের ২ জুন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৫ টাকার চেক প্রদান করেছিলো । পরবর্তী সময়ে স্থানীয়রা এই জমিকে লবন মাঠ হিসেবে দাবী করে নাল জমি হিসেবে ক্ষতিপুরণ নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা বিষয়টি ভূমি মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে।
এমন দাবীর প্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রনালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন করে এটিকে লবনমাঠ হিসেবে চিহ্নিত করে। জমির শ্রেনী পরিবর্তন হওয়ায় ক্ষতিপুরণ মূল্য নির্ধারিত হয় ১৬২ কোটি ৫৮ লাখ ১৪ হাজার ২৭১ টাকা ।
ক্ষতিপূরণ বাবদ অতিরিক্ত আরো ৮৭ কোটি ৪৬ লাখ ৫৪ হাজার ৯৯৬ দশমিক শূন্য এক টাকা পরিশোধ করতে গত আট জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এর প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গত ১৩ জানুয়ারি কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে এই টাকা দেয়।
কক্সবাজারের মহেশখালীতে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে লবন মাঠ হিসেবে অধিগ্রহণকৃত ভূমির ক্ষতিপূরণ মূল্য পাচ্ছে প্রকল্প এলাকার প্রায় ২ শতাধিক পরিবার। লবন মাঠ হিসেবে এখন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো পাবে একর প্রতি ৫৫ লাখ টাকা।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো: আল আমিন পারভেজ টিবিএসকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী অন্তত ১ জন জমির মালিক টাকা গ্রহণ করলে আমরা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে মাতারবাড়ি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জায়গার দখল বুঝিয়ে দিতে পারবো। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে দখল বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। এর ফলে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সব ধরনের জটিলতা কেটে গেলো।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) অর্থায়নে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার ধলঘাট এলাকায় নির্মিত হচ্ছে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর।
২০২০ সালের ১৬ নভেম্বর মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে নির্মাণ কাজ শেষ হলে মাতারবাড়ি বন্দরের টার্মিনালে ভিড়তে পারবে ১৮ মিটার গভীরতার জাহাজ। এই বন্দরে ৮ থেকে ১০ হাজার কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে।
মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২,৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২,৬৭১ কোটি টাকা। প্রকল্প নির্মানের মেয়াদ ২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
তবে, চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১ সালের জুন মাসে ভূমি মন্ত্রণালয় প্রায় ৮০৩ একর জমি সরকারের সম্পত্তি অধিগ্রহণ ম্যানুয়াল ১৯৯৭ এর ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তরের জন্য চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেয়।
এর প্রায় ৭ মাস পর গত ৩০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বন্দর কর্তৃপক্ষকে ১২০ দিনের মধ্যে উক্ত জমি বাবদ সরকারের স্হাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন-২০১৭ এর ৮(৪) বিধান অনুযায়ী ১২০ দিনের মধ্যে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে বলে।
এই চিঠির বিষয়ে গত ৩১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ে একটি চিঠি দেয়। বন্দর কর্তৃপক্ষ নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানায় এত টাকা পরিশোধ করা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সম্ভব নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী বন্দর তহবিল থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে এবং ৫০০ কোটি টাকা পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ বরাবর হস্তান্তর করা হয়। তাই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কর্তৃক যাচিত উক্ত প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা পরিশোধের সামর্থ্য বন্দর কর্তৃপক্ষের নেই।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের এই চিঠি বে টার্মিনাল প্রকল্পে তেমন অসুবিধা সৃষ্টি করবেনা। যেহেতু সরকারী খাস জমি তাই বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতীকি মূল্যে দেওয়ার জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে অবহিত করেছি। এটি নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। খাস জমি মন্ত্রণালয় থেকে মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করলে টাকা লাগার কথা নয়।
এদিকে বে টার্মিনাল প্রকল্পে জটিলতার বিষয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রাম একটি অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেছিলেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গত ২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দরে সার্ভিস জেটি উদ্বোধন করতে এসে সাংবাদিকদেরর এক প্রশ্নের জবাবে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেছিলেন এখানে জমি অধিগ্রহণে কিছুটা দুর্বলতা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলছে। মনে হয় এটা খুব দ্রুতই এটা শেষ হয়ে যাবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহন শাখার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এহসান মুরাদের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
২০১৫ সালে সমুদ্র উপকূলে এই প্রকল্প নির্মানের উদ্যোগ নেয় সরকার। সরকারি প্রকল্পের অগ্রাধিকার অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই মাসে বে-টার্মিনাল প্রকল্পটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) পদ্ধতিতে বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দেন। প্রকল্পটিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অর্থায়নে একটি টার্মিনাল এবং বাকি দুটি টর্মিনাল বিদেশি বিনিয়োগে নির্মাণ করা হবে।
২০১৯ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যক্তি মালিকানাধীন ৬৪ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনকে ৪০০ কোটি টাকা দেয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে আকারে চেয়ে প্রায় ৪ গুন বড় বে টার্মিনাল প্রকল্প ২০২৪ সালে এই প্রকল্প অপারেশনে যাবে বলে আশা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। চট্টগ্রাম বন্দের থেকে থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে নির্মিত হচ্ছে বে টার্মিনাল। এতে ১২ মিটার গভীরতা ও ৬ হাজার কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন ২৮০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজ অনায়াসে বার্থিং করতে পারবে। উক্ত টার্মিনাল নির্মিত হলে ২৪ ঘণ্টা নেভিগেশন সম্ভব।