দুর্নীতির কারণে ভূমির ডিজিটাইজেশনের সুবিধা পাচ্ছে না প্রান্তিক মানুষ: বিশেষজ্ঞরা
দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডিজিটাইজেশন করা হলেও গ্রামসহ অনেক স্থানেই সেই সেবার সুবিধা পাচ্ছে না জনগণ। তাই ভূমি অফিসগুলোতে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়া এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে না পারলে ডিজিটাইজেশন করেও ভূমির অব্যবস্থাপনা দূর করা সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন ভূমি বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও সিভিল সোসাইটির নেতৃবৃন্দ।
বৃহস্পতিবার এসডিজি বাস্তবায়নে গঠিত নাগরিক প্ল্যাটফর্মের 'ভূমি ব্যবস্থাপনায় সাম্প্রতিক উদ্যোগ ও নাগরিক অধিকার' শীর্ষক সংলাপে এসব কথা বলেন বিভিন্ন খাতের প্রতিনিধিরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং সংলাপের আহ্বায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী।
দুর্নীতিবিরোধী আর্ন্তজাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক এবং নাগরিক প্ল্যাটফর্মের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, "স্মার্ট বাংলাদেশ বলা হচ্ছে যেখানে ভূমি মন্ত্রণালয়ের ডিজিটাইজেশন একটি বড় উদ্যোগ। অবশ্যই ডিজিটাইজেশন হচ্ছে কিন্তু সেটি কতোটুকু নিষ্কণ্টক সেটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। সবার সম্পৃক্ততা আছে কিনা সেটিও বিবেচনায় আসা উচিত। দেশের প্রায় ৬৯% মানুষের ইন্টারনেটের অ্যাক্সেস নেই আবার দেশের ইন্টারনেট স্পিড দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বনিম্ন। এসব বিবেচনায় মানুষ কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছে না। এই দুই কারণে মানুষ সেবা পেতে কঠিন হবে।"
তিনি আরও বলেন, "আমাদের সাব রেজিস্ট্রি অফিসগুলোর প্রায় অর্ধেক অফিসেই জরাজীর্ণ অবস্থা। ল্যান্ড সার্ভিস দেওয়ার জন্য যারা জনগণের সাথে কাজ করে তাদের দক্ষতা আছে কিনা সে বিষয়েও লক্ষ্য রাখা উচিত সরকারের। ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাইজেশনের প্রচার-প্রচারণা অপরিহার্য বলে মনে করছি।"
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, "বাংলাদেশে যদি দুর্লভতম কোন সম্পদ থাকে সেটি হচ্ছে ভূমি। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি জায়গা বাংলাদেশ, সেখানে ভূমি নিয়ে সংগ্রাম, সংঘাত হবে না সেটা কল্পনাই করা যাবে না। ভূমির ব্যাপারটি বহুমাত্রিক বিষয়। বাংলাদেশের ৭ শতাংশ জায়গা বনায়নের মধ্যে আছে। সেটা ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে। আমাদের নতুন নতুন চর উঠছে, নদী ভরাট হচ্ছে এর সাথে খাস জমির বড় একটি বিষয় আছে। খাস জমির ব্যবহার এবং তার অভিগম্যতা। ভূমির বিষয়টি শুধু ভূমি মন্ত্রণালয়ের বিষয় না। এর সাথে অন্তত এক ডজন মন্ত্রণালয়ের সম্পৃক্ততা থাকে।"
তিনি আরও বলেন, "বর্তমান সরকার ভূমি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষ যাতে দুর্নীতিমুক্ত, বাধাহীনভাবে ব্যবহার করতে পারে, সেটিই চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশের বর্শা-ফলক হিসেবে কাজ করতে পারে ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাইজেশন। এর পূর্ণ রূপ দিতে হলে নাগরিক সমাজের সম্পৃক্ততা দরকার। এ উদ্যোগ সরকারের থাকতে হবে। বিভিন্ন কায়েমি স্বার্থের কাছে এসব উদ্যোগ যাতে নষ্ট হয়ে না যায় সে বিষয়েও পদক্ষেপ নিতে হবে।"
দেশের বিভিন্ন এলাকার এনজিও ও সংস্থার নেতৃবৃন্দ তাদের মতামত প্রকাশ করে বলেন, দেশে ডিজিটাল ভূমি সেবার কথা বলা হলেও এখনও মানুষকে ভূমি অফিসে গিয়ে মাসের পর মাস ঘুরতে হয়। এছাড়া বন্টন বিষয়ক নানা সমস্যায় পড়ছে সাধারণ মানুষ। ভূামি সংক্রান্ত মামলাগুলোও সহজে মীমাংসা হচ্ছে না।
আদিবাসীদের পক্ষে কয়েকজন দাবি করেন, তাদের অনেকেরই জমি দখল করে নিয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা চান ৯৭ ধারা বাস্তবায়ন হোক।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, "আমাদের কাছে কোনো ম্যাজিক নেই যে সবাই সোজা হয়ে যাবে। আমরা অনলাইন ফরমেট এমনভাবে তৈরী করেছি যে, অনিয়ম করার সুযোগই থাকবে না। আমাদের মূল টার্গেট হচ্ছে ভোগান্তি ফ্রি করা। পুরো বিষয়টি বিধির মধ্যে নিয়ে আসবো। আমরা ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করবো। জরুরি মিউটেশনের বিষয়ে আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি।"
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, "ভূমি সেবা পেতে এখনও হয়রানি হচ্ছে। ভূমি সম্পর্কিত যে সব সমস্যা রয়েছে, তার পুরোপুরি সমাধান সম্ভব হবে না। তবে আমরা জনগণের ভোগান্তি দূর করার জন্য যতদূর সম্ভব সেটা করেছি এবং টেকসই উন্নয়নকে সামনে রেখে কাজ করেছি। যাতে আগামীতে অন্য সরকার দায়িত্বে এলে তাদের নতুন করে শুরু না করতে হয়।"
তিনি বলেন, ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কর্মকর্তাদের কাজকে জবাবদিহির অধীনে আনা হয়েছে, যাতে কোনো মানুষ সেবা নিতে এসে দিনের পর দিন না ঘোরেন, হয়রানির শিকার না হন এবং অর্থ ব্যয় না করতে হয়। এ জন্য সেবাপ্রার্থীকেও সচেতন হতে হবে।"