মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে: ক্ষিপ্র, ভয়ঙ্কর এবং প্রাণঘাতী
ঢাকাকে ভাঙ্গার সাথে সংযুক্ত করার জন্য নির্মিত ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে। কথা ছিল এটি রাজধানীতে যাতায়াত সহজ করবে। কিন্তু তা না করে উল্টো এই এক্সপ্রেসওয়ে পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।
এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা না থাকা, ট্রাফিক নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখানো, স্পিড লিমিট না মানা, কে কার আগে যেতে পারে তা নিয়ে চালকদের অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া—এসব কারণে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে এখন দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক সড়কগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যানুসারে, গত সপ্তাহে তিন দিনে এই এক্সপ্রেসওয়েতে অন্তত দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ বলছেন, কিছু ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি, ফলে প্রকৃত সংখ্যাটি আরও বেশিই হবে।
হাসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফজাল হোসেন জানান, কেবল ২০২১ সালেই মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ১৯৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত এবং ২৬৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন।
চলতি বছর কেবল জানুয়ারিতেই এই এক্সপ্রেসওয়েতে ২৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত এবং ৫২ জন আহত হয়েছেন।
দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন করা হয় ২০২০ সালের মার্চে।
এর পর থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত, এক্সপ্রেসওয়েটিতে ইতিমধ্যে ৭৯টি দুর্ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৫ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৬৭ জন।
গত ১১ ফেব্রুয়ারি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মাওয়া ঘুরতে যান বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান।
ঢাকা ফেরত আসার পথে মাওয়া ঘাট থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে একদল উত্তেজিত জনতা দেখে থামেন তারা। উত্তেজিত জনতা ছাড়াও বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা ও একটি অ্যাম্বুলেন্স দেখেন হাদিউজ্জামান।
কিছু একটা ঝামেলা হয়েছে
তিনি জানান, একটি বাস আর একটি গাড়ি পার্ক করা ছিল সেখানে। গাড়িটির সামনের অংশ সম্পূর্ণ তুবড়ে গেছে। গাড়ি থেকে আহত যাত্রীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
কিন্তু দুর্ঘটনার সংখ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে, হাদিউজ্জামান যা দেখেছেন, তা এই এক্সপ্রেসওয়ের নিয়মিত ঘটনা।
পরিহাসের ব্যাপার হলো, অধ্যাপক হাদিউজ্জামানই এই এক্সপ্রেসওয়ের অবস্থার উন্নতি করার সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু তার প্রতিবেদনের পর দু-বছর পেরিয়ে গেলেও অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এক্সপ্রেসওয়েতে নিয়মিত যাতায়াতকারী আব্দুর রহমান রাফি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। 'গাড়ি আর বাইক স্পিড লিমিট লঙ্ঘন করে ভীষণ দ্রুত চলে। কিছু গাড়ি আর বাইক অকারণে রাস্তার মাঝখানে থামে।
বাসগুলো যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠা-নামা করায়। গাড়িও স্পিড লিমিট লঙ্ঘন করে, যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটে,' বলেন তিনি।
মাত্রাতিরিক্ত গতি, আর উদাসীনতা এই এক্সপ্রেসওয়েতে আসলেই বড় সমস্যা।
গতিসীমা লঙ্ঘনের জন্য দিনে ৫-৭টি মামলা
নবনির্মিত পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ঢাকাকে ভাঙ্গার সাথে সংযুক্ত করার জন্য ৫৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এক্সপ্রেসওয়েটি ১১ হাজার ৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়। এটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় ২০২০ সালের ১১ মার্চ।
পদ্মা নদীর এই পাড়ের ঢাকা-মাওয়া অংশটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। ফলে এই অংশে দর্শনার্থীদের বহনকারী যান চলাচলও বেশি হয়। এ কারণে এ অংশে দুর্ঘটনার প্রবণতাও বেশি।
গাজীপুর অঞ্চলের নারায়ণগঞ্জ হাইওয়ে সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট (এএসপি) অমৃত সূত্রধর টিবিএসকে বলেন, তারা প্রতিদিন প্রায় ৫-৭টি গতিসীমা লঙ্ঘনের মামলা দায়ের করছেন।
তিন বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রাইভেট কারগুলো ৮০ কিলোমিটারের স্পিড লিমিট ভঙ্গ করে। কিছু ক্ষেত্রে প্রাইভেট কারগুলো ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার গতিতেও চলে।'
অমৃত আরও বলেন, 'গতি পরিমাপের যন্ত্র রাডার গান সূর্যাস্তের পর কাজ করে না। তাই আমরা রাতের বেলায় অতিরিক্ত গতিতে যাওয়া যানবাহন থামাতে পারি না।'
অনভিজ্ঞদের জন্য এফ১ ট্র্যাক
চালকরা যদি শুধু স্বল্প জ্ঞানের কারণে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালাত, তাহলে সমস্যা অত বড় ছিল না—কিন্তু বড় উদ্বেগের কারণ হলো আনাড়ি স্পিড রেসাররা।
বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় বাসিন্দা ও নিয়মিত যাতায়াতকারী টিবিএসকে জানিয়েছেন, এক্সপ্রেসওয়েতে প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার ঘটেছে।
হাসাড়া হাইওয়ে পুলিশ থানার ওসি আফজাল হোসেন টিবিএসকে বলেন, বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই ঘটেছে মাত্রাতিরিক্ত গতিতে মোটরসাইকেল চালানোর কারণে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, তরুণদের বেপরোয়া রেস রাতের এক্সপ্রেসওয়েকে ভয়ংকর করে তুলেছে।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখবেন যে প্রাইভেট কারগুলো স্কিড করে এবং কংক্রিটের মিডিয়ানে আঘাত করে। অবিলম্বে এসব রেস বন্ধ করা উচিত।'
দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ির ছবিতেও দেখা গেছে, অতিরিক্ত গতির কারণে গাড়িগুলোর সামনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
৯৯৯-এর কর্মকর্তারাও নিশ্চিত করেছেন যে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনার খবর নিয়ে বেশিরভাগ সময় রাতের বেলাতেই তাদের কাছে ফোন আসে।
অমৃত সূত্রধর টিবিএসকে জানিয়েছেন, দুটি পৃথক টহল দল ব্যবহার করে ২৪ ঘণ্টা এক্সপ্রেসওয়ের ৮০ কিলোমিটারজুড়ে টহল দেন তারা। আরেকটি দল রাতের বেলায় চেকপোস্টে দায়িত্ব পালন করে।
তিনি আরও জানান, '৮০ কিলোমিটার জুড়ে (দুদিকে ৪০ কিলোমিটার করে) নজর রাখার জন্য টহল দল যথেষ্ট নয়। কখনও কখনও কোনো ইউ-টার্ন বা শর্টকাট থাকে না বলে অন্যপাশে পৌঁছানোর জন্য আমাদের প্রায় ১০-১৫ কিলোমিটার অতিরিক্ত গাড়ি চালাতে হয়।'
আনাড়ি চালক
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, এটি যেহেতু প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে, তাই চালকদের অভ্যস্ত হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে হাইওয়ে পুলিশ বলছে, তারা চালকদের প্রশিক্ষণ দেয়।
'প্রতিটি এক্সপ্রেসওয়ে বা প্রকল্প নির্মাণের আগে-পরে চার-ধাপের নিরাপত্তা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সড়ক ও জনপথ বিভাগ পোস্ট-অডিট করেনি,' বলেন হাদিউজ্জামান।
তিনি আরও বলেন, 'কোনো রাস্তায় যখন বাস বে থাকে, একে আপনি এক্সপ্রেসওয়ে বলতে পারবেন না। অথচ এই এক্সপ্রেসওয়েতে যত্রতত্র বাস থামে। স্পিডিং একটি প্রধান সমস্যা, কিন্তু পুলিশও সবসময় স্পিডগান ব্যবহার করতে পারছে না। তাই স্থায়ী এক্সপ্রেস কন্ট্রোল বা ডায়নামিক মেসেজ সাইন থাকা দরকার, যা দেখে চালক বুঝবে যে সে অতিরিক্ত গতিতে চলছে।
'এটি একটি পাইলট প্রকল্প এবং আমরা ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটে এমন একটি এক্সপ্রেসওয়ে চালু করতে যাচ্ছি। তাই প্রথম এক্সপ্রেসওয়েটি মডেল ও দুর্ঘটনামুক্ত হওয়া উচিত।'
এক্সপ্রেসওয়েতে নেই সিসিটিভি ক্যামেরা
সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সড়ক নিরাপত্তা বিভাগের কর্মকর্তা নাজমুল হুদা টিবিএসকে জানান, তারা ইতিমধ্যে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায় ১ হাজার সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
'মন্ত্রণালয় এখন প্রস্তাবিত প্রকল্পটি মূল্যায়ন করছে, যা একনেকে অনুমোদন পাবে। এরপর আমরা টেন্ডার ছাড়ব। প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় লাগবে,' যোগ করেন তিনি।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, সংলগ্ন এলাকার লোকজন প্রায়ই বুকসমান উচ্চতার এক্সপ্রেসওয়ে ব্যারিয়ার পার হয়; এছাড়া অবৈধভাবেও এক্সপ্রেসওয়ে পার হয় তারা।
'এক্সপ্রেসওয়েতে হাঁটছে বা এক্সপ্রেসওয়ে পেরোচ্ছে, এমন যাত্রী বিশ্বের কোনো দেশে খুঁজে পাবেন না,' মন্তব্য করেন নাজমুল হুদা।
এর ফলে এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে।
জাতীয় জরুরি সেবার নম্বর ৯৯৯ থেকে কল পেয়ে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ সম্প্রতি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের ইকুরিয়া এলাকা থেকে কনস্টেবল হুমায়ুন কবিরের মৃতদেহ উদ্ধার করে। জানা যায়, বাড়ি ফেরার পথে রাস্তা পার হওয়ার সময় ঢাকাগামী একটি প্রাইভেটকার হুমায়ুন কবিরকে ধাক্কা দেয়।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ টিবিএসকে বলেন, 'ঘটনাস্থল থেকে আমরা প্রাইভেট কারের সামনের বাম্পারের একটি ক্ষতিগ্রস্ত অংশ উদ্ধার করেছি। কিন্তু কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারিনি, ২ ফেব্রুয়ারি রাতে ওই পুলিশ কনস্টেবলকে চাপা দেওয়া গাড়িটিও খুঁজে বের করতে পারিনি।'
গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের নিমতলা এলাকার পূর্বপাশ থেকে মানিকগঞ্জ সদরের ভাটভোগ এলাকার বাসিন্দা রমিজ উদ্দিনের (৪২) লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানতে পারে মাওয়াগামী একটি দ্রুতগামী গাড়িটি তাকে চাপা দেয়। তাতে রমিজ উদ্দিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ঘটনার পাঁচ মাস পরও পুলিশ জানতে পারেনি প্রাইভেট কার না বাস, কোনটি এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে।
স্থানীয়রা অবশ্য দাবি করেছেন যে সবসময় পথচারীরাই দুর্ঘটনা ঘটায় না। শেয়াল-বিড়াল এবং অন্যান্য প্রাণী রাতে রাস্তা পার হওয়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে।
কুচিয়ার মোড় এলাকার বাসিন্দা আহমদ মুসা টিবিএসকে বলেন, 'আমাদের পর্যাপ্ত ফুটব্রিজ নেই। প্রয়োজনের সময় আমরা এক্সপ্রেসওয়ের অপর পাশে যাব কীভাবে? কর্তৃপক্ষের উচিত আরও ফুটব্রিজ স্থাপন করা।'
দুর্বল চিকিৎসা সেবা
এনএম অনিক নামে একজন মোটরসাইকেল চালক দাবি করেন, কেউ ছোটখাটো দুর্ঘটনার শিকার হলেও চিকিৎসার জন্য লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয়। কারণ আশেপাশে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই।
তিনি বলেন, 'এক্সপ্রেসওয়ের আশপাশে কোনো চিকিৎসাকেন্দ্র নেই। কেউ গুরুতর আহত হলে তাকে চিকিৎসার জন্য স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং মাঝে মাঝে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেতে বিলম্ব হওয়ায় তাদের জখম আরও গুরুতর হয়ে ওঠে।'
নারায়ণগঞ্জের এএসপি অমৃত সূত্রধর বলেন, এক্সপ্রেসওয়ের আশপাশে দুটি চিকিৎসা কেন্দ্র রয়েছে—শ্রীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং স্বদেশ হাসপাতাল। তবে বড় দুর্ঘটনা ঘটলে আহতদের রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠাতে হয়।
সিনিয়র সহকারী সচিব ও মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) কেয়া দেবনাথ টিবিএসকে বলেন, তিনি প্রায়ই এক্সপ্রেসওয়ে এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার খবর পেতেন।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চালকেরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়, আর মালিকরা চালকদের ঘাড়ে দোষ চাপায়।