বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে ডাক্তার হোক, হয়ে গেলেন মাল্টিন্যাশনালে দেশের প্রথম নারী এমডি
গত শতাব্দীর আশির দশকের শুরুর দিকে যখন ছাত্রীদের মধ্যে ব্যবসায় প্রশাসনে পড়ার ঝোঁক বলতে কিছু ছিল না, সেই সময় রূপালী হক চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে পড়েন। পড়াশোনা শেষ করে সবাই যখন সরকারি চাকরিতে ঢোকার চেষ্টায় রত, সেই সময়েও রূপালী চৌধুরীর যাত্রা ছিল স্রোতের বিপরীতে; যুক্ত হন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে।
একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে নিজ দক্ষতায় এখন তিনি শীর্ষস্থানীয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম কোনো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি। নেতৃত্ব দিয়েছেন বিদেশি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিসহ (এফআইসিসিআই) ব্যবসায়ীদের বড় বড় সংগঠনেরও।
তবে এইচএসসি পাসের পর মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা দিয়েও ভর্তির সুযোগ পাননি তিনি।
মেডিকেল কলেজে চান্স না পাওয়া ও জীবনে পেছনে না তাকানোর মানসিকতাই তাকে শীর্ষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলে জানিয়েছেন রূপালী চৌধুরী। নারী দিবস উপলক্ষ্যে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই জানান এ সফল নারী। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন টিবিএসের সিনিয়র প্রতিবেদক আব্বাস উদ্দীন নয়ন।
শুরুটা সাধারণ
রূপালী হক চৌধুরীর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়ায়। তার বাবা প্রিয় দর্শন চৌধুরী ছিলেন একজন চিকিৎসক। কলকাতায় পড়াশোনা করে সেখানেই চিকিৎসা পেশায় যুক্ত হন। কিন্তু রূপালী চৌধুরীর দাদি তার ছেলেকে বললেন, 'এখানে মানুষ রোগে মারা যায়, আর তুমি বিদেশে রোগ সারাও!'
রূপালী চৌধুরীর বাবাকে ফিরে আসতেই হলো। ১৯৫৭ সালে ফিরে এসে তিনি চট্টগ্রামের পটিয়ায় চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। ওই সময় রোগীপ্রতি দুই টাকা ভিজিট (সম্মানী) নিতেন তার বাবা, জানান রূপালী চৌধুরী।
তিনি বললেন, 'বাবা আমার চোখে আনসাং হিরো (অবিসংবাদিত নায়ক)। ওই সময় কলকাতার পসার ছেড়ে পটিয়ায় ফেরা সহজ ছিল না।'
মা–বাবার পাঁচ সন্তানের মধ্যে রূপালী চৌধুরী চতুর্থ। বড় বোন শ্যামলী চৌধুরী গৃহিণী। ভাই শ্যামল বিকাশ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত। মেজ বোন অঞ্জলি চৌধুরী মারা গেছেন। ছোট ভাই কমল জ্যোতি চৌধুরী ব্যবসায়ী।
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'আমাদের পরিবার ছিল অসম্ভব সংস্কৃতিমনা। পটিয়ায় আমাদের শৈশব, কৈশোর খুব আনন্দে কেটেছে। সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতি কখনো টের পাইনি। আমাদের প্রচুর মুসলমান ও হিন্দু বন্ধু ছিল। স্থানীয় বিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষা শেষ করে বাবার ইচ্ছায় রূপালী চৌধুরী মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে ওই সময় দুই ব্যাচের একসঙ্গে পরীক্ষা হওয়ায় পেরে ওঠেননি রুপালী চৌধুরী।
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'মেডিকেলে চান্স না পাওয়াটা পরিবারের জন্য হার্ট ব্রেকিং ছিল। আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রিতে ভর্তি হলাম। কিন্তু আমার খুব কাছের বন্ধু আব্দুল হকের (বর্তমানে স্বামী) প্রেরণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ করি। আমার ফ্যামিলি থেকে নিরুৎসাহিত করা হয়। তবে তার প্রচেষ্টায় আমি ঢাকা আসি।'
স্মিত হেসে রূপালী চৌধুরী বলেন, 'অনেকে বলেন, প্রেমের জন্য তুমি এমবিএ করছো।'
তিনি বলেন, 'তার অনুপ্রেরণাতেই ১৯৮৪ সালে সিবা গেইগিতে একজন সাধারণ কর্মী হিসাবে যোগ দেই। কোম্পানির প্লানিং ইনফরমেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল অফিসার হিসাবে শুরুর কাজ ছিল বিভাগীয় প্রধানকে বিক্রয় ও ব্যবস্থাপনার তথ্য দিয়ে সহায়তা করা। সেখানে দারুণ সুনাম করেছি আমি। কিছুদিন পরই আমাকে প্রডাক্ট ম্যানেজমেন্ট বিভাগে বদলি করা হয়। সব মিলিয়ে সিবা গেগিতে ছয় বছর চাকরি করার পর বার্জারে চলে যাই। বার্জারে ৩২ বছর যাবত কর্মরত আছি।'
পারিবারিক কারণে বার্জারে চাকরি
নব্বইয়ের দশকে সিবা গেগি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি ছিল। কাজের দক্ষতার কারণে রূপালীর চৌধুরীর অবস্থানও বেশ শক্ত ছিল। তবে পারিবারিক কারণে চট্টগ্রাম যাওয়ায় বার্জারে যোগ দিতে হয়।
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'দীর্ঘদিনের জানাশোনার পর ১৯৮৯ সালে আব্দুল হক এবং আমি বিয়ে করি। বিয়ের এক বছর পর আমার হাজবেন্ড চিটাগংয়ে ট্রান্সফার হয়ে যায়। পারিবারিক কারণে তখন চট্টগ্রামে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।'
তিনি বলেন, 'আমি চট্টগ্রামে থাকার জন্য একটি চাকরি খুঁজছিলাম। পত্রিকায় বার্জারের একটি পদে লোক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখলাম। তারা বেশ কয়েকদফা সাক্ষাৎকার নিলেন। পরিকল্পনা ব্যবস্থাপক পদে একটি মেয়ে কাজ করতে পারবে কি না, এটা নিয়ে তারা দ্বিধায় ছিলেন।'
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'অনেক কষ্টে আমার চাকরিটা হয়। ওই পদে সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধিদের সঙ্গে কাজ করতে হবে, কাস্টমসের সঙ্গে কাজ করতে হবে, বন্দরে যেতে হবে। ওই সময় একটি মেয়ে এসব কাজ করতে পারবে, সেটা তারা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।'
নারীদের নিয়ে বার্জারের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভয়কে জয় করতে সক্ষম হন রূপালী চৌধুরী। বিভিন্ন বিভাগে কাজ করার পর ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত হন তিনি। তিনি বলেন, 'আমি নারী, এই ভেবে নিজে থেকে কখনো গুটিয়ে যাইনি।'
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'যোগ দেয়ার পর নিজের কাজ শেষ করে বিভাগীয় প্রধানের কাজে সাহায্য করতাম। ওই সময় ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সহকারী হিসাবেও কাজ করেছি। কোম্পানিকে ম্যানুয়াল পদ্ধতি থেকে কম্পিউটারাইজড করার কাজটাও আমার হাত দিয়ে হয়েছে।'
যেভাবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক
দায়িত্ববোধ এবং উদ্ভাবনী মানসিকতা তাকে বার্জারের মতো কোম্পানির এমডি পর্যায়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করেন রূপালী চৌধুরী।
তিনি বলেন, 'ম্যানুয়াল থেকে কম্পিউটারাইজড করার কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্লানিং ম্যানেজার থাকার সময়ই সেলস বিভাগের কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও আমি করে দিয়েছি। কয়েক বছর পর হঠাৎ করে বার্জারের মার্কেটিং ম্যানেজার চলে গেলো। তখন কোম্পানি আমাকে এক প্রকার জোর করে এ দায়িত্ব দিলো। প্রথম দিকে আমি একটু ভয়ে ছিলাম। ছেলে-মেয়ে দুজনই ছোট। পরিবারকে সময় দিয়ে কাজ করা খুব কঠিন।'
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'তখন আমি থাকি চট্টগ্রামে কিন্তু মার্কেটিংয়ের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য পক্ষগুলো ঢাকায়। দুটোর সমন্বয় কিভাবে করবো? এসব ব্যাপারে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তবে তখনকার এমডি আমাকে আশ্বাস দিলেন। তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বললেন, এক জায়গা থাকা যাবে না। এরপর আমি শুরু করলাম। কয়েকদিন পর কোম্পানি আমাকে জিএম অপারেশনের দায়িত্বও দিলো। সব দায়িত্বই আমি ভালোভাবে সম্পন্ন করেছি। ২০০৪ সালে এসে ডিরেক্টর, অপারেশনস বানানো হলো। এরপর ২০০৮ সালে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হলো।'
ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার পর রূপালী চৌধুরী নিজেকে যে বিষয়টিতে এগিয়ে রেখেছেন বলে মনে করছেন তা হলো সততা, কাজের প্রতি একাগ্রতা, প্রতিশ্রুতি এবং কঠোর পরিশ্রম।
তিনি বলেন, 'অনেকেই মনে করেন আমি মেধার বলে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেছি। কিন্তু মেধা বা ট্যালেন্ট শুধু একটা বিষয়। বাকিটা হলো ইনোভেশন, অনেস্টি, ইন্টিগ্রেটি, কমিটমেন্ট অ্যান্ড হার্ড ওয়ার্কিং।'
অফিসের কাজে কেমন সময় দিতেন এমন প্রসঙ্গে রূপালী চৌধুরী বলছেন, 'আমি সব সময়ই টাইম নিয়ে সতর্ক থাকতাম। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বড়জোড় কাজ করতাম। এখনও তাই করছি। কখনোই কোন কাজ পেন্ডিং থাকতো না। কমিটমেন্ট রক্ষা করতাম।'
নেতৃত্বের জন্য কি গুণ দরকার বলে মনে করেন এমন প্রশ্নে রূপালী চৌধুরী বলেন, 'আমি যে কাজটা করছি সেটা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান সবার আগে দরকার। এরপর একটি ভিশন ও মিশন ঠিক করতে হয়। আরেকটি বড় বিষয়ে জ্ঞান রাখতে হয় তা হলো- আগামী ৫-১০ বছর পর আমাদের পণ্যের বাজার চাহিদা কী থাকবে। ১০ বছর পর আমার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার নীতি কী হবে তা ঠিক করা।'
নারী কর্মী নিয়োগে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে
নারীর অর্থনৈতিক মুক্তির পথে পরিবারের পাশাপাশি কখনো কখনো করপোরেট বসরাও বাধা বলে মনে করেন রূপালী চৌধুরী।
তিনি বলেন, 'অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান মনে করেন পরিবারকে সময় দেয়ার কারণে নারীরা অফিসে কম দেন। কিন্তু আমি দেখেছি, তারা অফিসে সময় কম দিলেও ফ্রুটফুল সময় দেন। অফিসে আড্ডা কম দেন। আন্তরিকতার সাথে কাজ করেন। ওই ধারণাটা পাল্টাতে হবে। একইসঙ্গে দেশের সিকিউরিটি ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে হবে। প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে তাদের মোট কর্মীর ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের অনুপাত ঠিক করে দিতে হবে।'
'আমার পরামর্শ হলো- মেয়েদের তাদের নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেদের নিতে শিখতে হবে। হাত উঠিয়ে বলতে হবে আমি পারবো। আমি অনেক মেয়েকে দেখি ইন্টারের পরে আর ইউনিভার্সিটি যায় না। কেউ কেউ ইউনিভার্সিটি শেষ করেও জব করতে সাহস পায় না। এ জায়গা থেকে বের হতে হবে।'
আটপৌরে বাঙালি নারীর জীবন রূপালী চৌধুরীর
সব সময় শাড়ি পরেন। কপালে মাঝেমধ্যে টিপও দেখা যায়। ভাত-মাছ-ডাল বিশেষ পছন্দের খাবার। পরিবারকে সময় দেন। সব মিলিয়ে তিনি নিরেট বাঙালি নারী।
বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরির কারণে দেশে-বিদেশে ঘুরলেও তার পছন্দের খাবার ভাত, মাছ আর ডাল। প্রায় সব মাছই ভালো লাগে। রূপালী চৌধুরী গান গাইতে পারেন। পারিবারিকভাবেই সংস্কৃতিমনা এবং বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করেন।
রূপালী চৌধুরীর দুই সন্তান। ছেলে রাহুল হক কানাডায় পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসে রেস্তোরাঁ ব্যবসা শুরু করেছে। মেয়ে পূর্ণা হক কানাডায় পরিবেশবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ছে। স্বামী আব্দুল হক সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির (এসএমসি এন্টারপ্রাইজ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
রূপালী চৌধুরী বলেন, 'অফিসের বাইরে যতটুকু সময় পাই তা পরিবারকে দিতে চেষ্টা করি। আমরা দুজনই চাকরি করার কারণে ছেলেমেয়েদের সময় একটু কমই দেয়া হতো। তাই সুযোগ পেলেই ওদের নিয়ে ঘুরতাম।'
করপোরেট জীবন ও পারিবারিক কাজের বাইরে আরো কোথাও সম্পৃক্ততা রয়েছে নাকি এমন প্রশ্নে হাসি দিয়ে রূপালী চৌধুরী বলেন, 'সময় কোথায়……..। তবে অবসরে বই পড়ি। ফিকশন নয়, জীবনীমূলক বই পড়ি।'
বার্জার প্রসঙ্গে
জার্মান নাগরিক লুইস বার্জার ১৭৬০ সালে যুক্তরাজ্যে বার্জার প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে কারখানা করে ১৯৭০ সালে। পৃথিবীর অনেক দেশে বার্জারের ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশে রঙের বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বার্জারের। বাজার জরিপ অনুযায়ী, বার্জারের হিস্যা ৫০ শতাংশের মতো।
২০২০-২১ হিসাব বছরে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের মোট পণ্য বিক্রির পরিমাণ ১ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। রূপালী চৌধুরী যখন বার্জারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন, তখন প্রতিষ্ঠানটি ৩৫০ কোটি টাকার মতো পণ্য বিক্রি করত।