পাবলিক টয়লেট সংকটে ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য
কর্মজীবী নাজনিন আক্তার অফিসে যাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা আগে খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন। কারণ ঢাকার ব্যস্ততম এলাকাগুলোতেও পাবলিক টয়লেট খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয় না। এক শনিবার ফার্মগেট এলাকায় এক ঘণ্টার বেশি সময় যানজটে আটকা পড়েন, পাবলিক টয়লেট খুঁজতে বাস থেকে নেমে পড়েন। কিন্তু আশেপাশে কোথাও ব্যবহারযোগ্য পাবলিক টয়লেট খুঁজে পাননি তিনি। পরে একটি বেসরকারী অফিসের ভবনের টয়লেট ব্যবহার করেন।
পাবলিক টয়লেট সংকটের কারণেরাজধানীতে বসবাস করা প্রায় আড়াই কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত এ ধরনের পরিস্থিতিতে পড়েন।
ফলে রাস্তার পাশে, ফুটপাত, গাছের আড়াল, এমনকি ফুটপাতেই প্রস্রাব করছে বিভিন্ন গন্তব্যে বের হওয়া মানুষজন।
কিন্তু যারা এটি করেন না এবং নারী, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নানা রকম শারীরিক জটিলতায় পড়ছেন এ কারণে।
বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইড তিন বছর আগের এক জরিপ চালিয়েছিলো। সেই জরিপে দেখো যায় ঢাকায় বসবাসরত ও বহিরাগত মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন চলাচল করে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১ কোটি হবে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাজধানীতে এতো সংখ্যক মানুষের জন্য দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে সচল পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ১০৩ টি।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মালিকানাধীন পাবলিক টয়লেট থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশ ব্যবহারের উপযোগী নয়। একদিকে পরিচ্ছন্নতার অভাব অন্যদিকে নারী ও প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী নয়।
সালমা বেগম টিবিএসকে বলেন, ঢাকায় টয়লেট সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। অধিকাংশ স্থানে যেমন সংকট রয়েছে তেমনি কোথাও টয়লেট থাকলেও সেগুলো প্রয়োজনীয় স্থানে নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মোহাম্মদ আবুল কাশেম টিবিএসকে বলেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের জনগনের তুলনায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা অপ্রতুল। এরপরেও আমরা চাহিদার ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে টয়লেট নির্মাণ করছি। তবে কিছু স্থানে জমি সংকট থাকার কারণে প্রয়োজন থাকলেও নির্মাণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর সার্কেল) মুন্সি মো. আবুল হাসেম টিবিএসকে বলেন, আমাদের সিটিতে নতুন করে যেখানেই সেকেন্ডারি বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্র (এসটিএস) নির্মাণ করা হচ্ছে সেখানেই চেষ্টা করা হচ্ছে একটি করে পাবলিক টয়লেট তৈরি করার। আর দক্ষিণের নতুন সবগুলো পাবলিক টয়লেটে পুরুষ, মহিলা, প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থাসহ শিশুদের ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণারও থাকবে এমন ১৫ টি পাবলিক টয়লেট এবছর নির্মাণ করা হবে।
যেগুলো ইজারা দেওয়া আছে সেগুলোও এনজিওর মাধ্যমে পরিচালনার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তিনি।
অসহায় নিম্ন আয়ের মানুষরা
সিটি কর্পোরেশনের পাবলিক টয়লেট ব্যবহারের জন্য ৫ টাকা, গোসলের জন্য ১০ টাকা, লকার সুবিধার জন্য ৫ টাকা এবং পানি খাওয়ার জন্য ১ টাকা দিতে হয়।
কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া বা এনজিওর মাধ্যমে পরিচালিত অনেক পাবলিক টয়লেটে ব্যবহারকারীদের দ্বিগুণ টাকা গুণতে হয়, জানিয়েছেন টয়লেট পৃষ্ঠপোষকরা।
ফলে টাকা বাঁচাতে রাস্তার পাশে, ফুটপাতে প্রস্রাব করেন তারা।
এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে রাজধানীর গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া মোড়ে। এখানে পাবলিক টয়লেটের উল্টো পাশের সড়কের আড়ালে প্রসাব করতে দেখা যায় প্রায় সময়ই।
একটি বাসের চালকের সহকারি রাজিব বিশ্বাস টিবিএসকে বলেন, অনেকেই এসেছে তাই আমিও এখানে এসছি। আর সরকারি টয়লেটও কেন টাকা দিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
টয়লেট সংকটে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ শামীম টিবিএসকে বলেন, দীর্ঘ সময় প্রসাব চেপে রাখার ফলে মূত্রনালির সংক্রমণসহ নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন অনেকেই।
"তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নারীরা। অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। বারবার যদি কারো ইউটিআই হয়, তাহলে তা নারীর প্রজনন ক্ষমতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে", বলেন তিনি।
প্রস্রাবে ইউরিয়া এবং অ্যামিনো অ্যাসিডের মতো টক্সিন জাতীয় পদার্থ থাকার কারনে বেশিক্ষণ চেপে রাখার ফলে বিষাক্ত পদার্থ কিডনিতে পৌঁছে কিডনিতে স্টোন বা পাথর তৈরি করতে পারে উল্লেখ করেন তিনি।
এছাড়া প্রস্রাব চেপে রাখার কারণে ব্লাডার ফুলে যেতে পারে। সেই সঙ্গে কারো যদি আগে থেকে কিডনিতে কোন সমস্যা থাকে এবং সে নিয়মিত প্রস্রাব চেপে রাখে তাহলে ক্রমে তার কিডনি কার্যক্ষমতা হারাতে শুরু করবে। এজন্য রক্তের বিভিন্ন সংক্রমণসহ নানা ধরনের সংক্রমণ হতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, দুই সিটি কর্পোরেশন পাবলিক টয়লেট নির্মাণ আরও বাড়াতে হবে।
"মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী খুব বড় পরিসরে পাবলিক টয়লেট করতে না পারলেও ছোট পরিসরে পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা জরুরি। এজন্য সিটি করপোরেশনকে জমি খুজে বের করতে হবে এবং এর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। একটি আধুনিক শহর গড়ার অন্যতম অনুষঙ্গ পাবলিক টয়লেট", যোগ করেন তিনি।
আদিল বলেন, শহরের বিভিন্ন মসজিদ, বিভিন্ন মার্কেট, তেল ও গ্যাসের পাম্পে টয়লেটগুলো ব্যবহার উপযোগী করে সর্বসাধারণ যেন ব্যবহার করতে পারে সেই প্রক্রিয়া গ্রহণ করতে পারে নগর কতৃপক্ষ।