স্কুল বাস সব গেল কই?
রাজধানীর যানজট নিরসনে ও স্কুল শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য এক যুগেরও বেশি সময় আগে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি) স্কুল বাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ২০০৯ সালের ২০ আগস্ট নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত আদতে কোনো কাজে আসেনি।
সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রাথমিকভাবে ১৪টি বিআরটিসি বাস নিয়ে এ সার্ভিস চালু হয়। পরবর্তীতে রাজধানীর বিভিন্ন রুটে বিআরটিসির আরও বেশ কয়েকটি বাসে স্কুল শিক্ষার্থীদের পরিবহনের করার কথা থাকলেও উল্টো কয়েক মাসের মধ্যেই চালু হওয়া স্কুল বাস সার্ভিসটিও বন্ধ হয়ে যায়।
এদিকে, স্কুল বাস চালু অথবা বন্ধ হওয়ার বিষয়ে কিংবা সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কিছুই জানে না মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার পর রাজধানীর যানজট অসহনীয় পর্যায়ে বেড়ে গিয়েছে। আর এর প্রধান কারণ ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি। এর বড় একটি অংশ রাস্তায় চলাচল করছে স্কুলের শিশুদের আনা নেওয়ার কাজে। যদি স্কুল বাস সার্ভিস পরিকল্পনা অনুযায়ী চালু করা হয়, তবে এ যানজট অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মন্তব্য তাদের।
অভিভাবকরা বলছেন, যদি দূরবর্তী স্কুলগুলো বাস সার্ভিস চালু করে, তাহলে যেমন তারা নিজেদের সন্তানদের নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন, তেমনি একটি বড় খরচ ও সময় বেঁচে যাবে তাদের।
ডিএমপির রমনা ট্রাফিক জোনের সহকারী কমিশনার মোঃ রেফাতুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, কেবল ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেইলি রোড শাখায় প্রায় ২০ হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি শিক্ষার্থীদের নামায় এবং উঠায়। আগে অভিভাবকরা স্কুল ভ্যান বা বাসের মাধ্যমে সন্তানদের পাঠাতেন। কিন্তু আজকাল তারা এটি করছেন না।"
মিরপুর-১০ থেকে ফার্মগেটের হলিক্রস স্কুলে প্রতিদিন ৭ম শ্রেণির শিক্ষার্থী শারমিনকে নিয়ে যান তার মা শামসুন্নাহার। সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু হওয়ায় ৭টার দিকেই বাসা থেকে বের হতে হয় তাদের। এতটুকু রাস্তা পৌঁছাতে সময় লাগে দেড় ঘণ্টারও বেশি। গত কয়েকদিন ধরে অসহনীয় যানজটের কারণে সময় আরও বেশি লাগছে।
শামসুন্নাহার টিবিএসকে বলেন, "মিরপুর-১০ থেকে যে কয়দিন বাসে গিয়েছি একদিনও বাচ্চার ক্লাসের সময়ে পৌঁছাতে পারিনি। সংসারের সব কাজ রেখে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ওকে নিয়েই থাকতে হয়। এছাড়া ছুটির সময় মাঝে মাঝে জ্যামের কারণে ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। যদি স্কুল বাস সার্ভিস থাকতো, তবে নিশ্চিন্তে বাচ্চাকে বাসে তুলে দিতে পারতাম; আবার নামিয়েও নিতাম। খরচ, সময়, ভোগান্তি সবকিছু থেকেই মুক্তি পেতাম।"
ইস্পাহানী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক লিপিকা চক্রবর্তী বলেন, "আভিভাবকরা তাদের সন্তানকে নিয়ে খুবই চিন্তায় থাকেন। এজন্য তারা নিজেরাই স্কুলে নিয়ে আসে তাদের, আবার ছুটির সময়েও নিয়ে যায়। এতে অভিভাবকদের অনেক সময় নষ্ট হয়। স্কুল বাস থাকলে তারা সন্তানকে একা স্কুলে পাঠাতে নিরাপদ বোধ করতো।"
"কিন্তু সেক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। কারণ আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সীমিত বেতন নেই। এই বেতন দিয়ে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা অসম্ভব", যোগ করেন তিনি।
বিয়াম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী এহসানুল আলম বলেন, "মতিঝিল থেকে মগবাজার আসতে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। পাবলিক পরিবহনে এত যাত্রী থাকে, সেখানে দাঁড়ানোর মতো জায়গাও থাকে না। স্কুল ছুটির পর বাসায় গিয়ে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি।"
২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি, যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পল্লবী থেকে আজিমপুর পর্যন্ত স্কুল বাস সার্ভিসের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করেন।
এ সময় ডিটিসিবির অতিরিক্ত নির্বাহী সচিব এস এম সালেহউদ্দিন বলেন, "আমাদের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের জন্য সহজ গণপরিবহন তৈরি করা এবং একই সঙ্গে ৪০ শতাংশ যানজট কমিয়ে নিয়ে আসা।"
ডিটিসিবি এ সময় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন এবং বেসরকারি বাস অপারেটরদের সঙ্গে সকাল ৭টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত স্কুলের শিশুদের জন্য রাজধানীর প্রধান কেন্দ্রগুলোতে ১০০টি বাস চালুর চুক্তি করে। এসব বাস আবার শিশুদের বাড়িতেও পৌঁছে দেবে।
বিআরটিসির চেয়ারম্যান মোঃ তাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "রাজধানীতে স্কুল বাস সার্ভিস চালুর সিদ্ধান্ত কবে নেওয়া হয়েছিল আমার জানা নেই। এছাড়া শিক্ষার্থীদের জন্য স্পেশাল বাস সার্ভিসের নতুন কোনো পরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি। তবে রাজধানীর ধানমন্ডি ও উত্তরায় শিক্ষার্থীদের জন্য স্পেশাল ৬টি করে চক্রাকার বাস চালু করেছি করোনার পরে। যেগুলো আগে বন্ধ ছিল।"
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উইংয়ের পরিচালক প্রফেসর ড. একিউএম শফিউল আজম টিবিএসকে বলেন, "স্কুল বাস চালু কিংবা বন্ধের বিষয়ে আমার জানা নেই। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে আসেনি।"
স্কুল বাসের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল কিনা জানা নেই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব একেএম আফতাব হোসেন প্রামানিকেরও। তিনি বলেন, "অনেকদিন আগের বিষয় তো, খুঁজে দেখতে হবে। স্কুলবাস নিয়ে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে কিনা সে বিষয়ে আমার জানা নেই।"
এ বিষয়ে নগর-পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, "যে কোনো শহর যানজটমুক্ত করতে ডেডিকেটেড বাস সার্ভিস অন্যতম ভূমিকা রাখে। আর রাজধানী ঢাকার এই অসহনীয় যানজটের অন্যতম কারণ ব্যক্তিগত গাড়ি। যদি স্কুল শিক্ষার্থীদের পরিবহনে স্কুলবাস সার্ভিস চালু হয়, তবে যানজট যেমন কমবে, তেমনি অভিভাবকদের খরচও কমবে; শিশুদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।"
তিনি আরও বলেন, "স্কুল বাস সার্ভিস চালু হওয়ার পরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের না জানার বিষয়টি এক প্রকার দায়িত্বহীনতার পরিচয়।"