প্রতিদিন যেভাবে যানজটের সঙ্গে জীবনকে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে ঢাকার যাত্রীরা
করোনাভাইরাস মহামারি শেষে বহুদিন বন্ধ থাকা স্কুল-কলেজ খোলার পর থেকেই বাড়তি যানজটের কারণে আগের তুলনায় আয় কমে গেছে উবার চালক মো. আরিফের।
'আগে যে ট্রিপে ২০ মিনিট সময় লাগতো, এখন একই গন্তব্যে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় জ্যামেই বসে থাকতে হয়। আমার আয় আগের চেয়ে কমে গেছে,' খেদোক্তি করেন তিনি।
তারপর আরিফ গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে রাস্তায় চলাচল শুরু করেন।
'ম্যাপ থেকে আপনি বুঝতে পারবেন কোন রাস্তায় জ্যাম বেশি আছে। আর ম্যাপটিতে সবচেয়ে সহজ রাস্তাটাও দেখিয়ে দেওয়া হয়। যেমন ধানমন্ডি থেকে মগবাজার যেতে হলে এখন আর আমি পান্থপথ দিয়ে না গিয়ে সাত রাস্তা ব্যবহার করি। দূরত্ব বেশি হলেও তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়,' বলেন আরিফ।
ঢাকা শহরের যাত্রী-চালকদের জন্য এখন গুগল ম্যাপ একটি অন্যতম সহায়ক বস্তু। গুলশানের কনফিডেন্স গ্রুপ-এ প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেন ইকবাল মাহমুদ। মঙ্গলবার উত্তরাতে তার একটা মিটিং ছিল।
তিনি বলেন, 'সকাল সাড়ে এগারটায় গুলশান থেকে রওনা দেই। একঘণ্টা বনানী কবরস্থান এলাকায় জ্যামে আটকে ছিলাম। সময় পার হয়ে যাওয়ায় পরে মিটিং বাদ দিতে হয়েছিল।'
এরকম সমস্যায় ভবিষ্যতে না পড়তে আজকাল তারা সশরীর-মিটিং এড়িয়ে অনলাইনে মিটিং করার চেষ্টা করছেন বলে জানান ইকবাল মাহমুদ।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক-এর গুলশান অ্যাভিনিউ'র প্রধান কার্যালয়ে কাজ করেন নুসরাত ইভা। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, হাঁটাই এখন তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপায়। প্রতিদিন প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটে অফিসে যান তিনি। তাতেও কোনো কোনোদিন যথাসময়ে অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়।
'যানজটের কারণে আমাদের ব্যক্তিগত জীবন মরে গেছে,' দুঃখ করেন রেনাটা লিমিটেড কোম্পানির শান্তিনগর অঞ্চলের বিক্রয় প্রতিনিধি মো. আলমগীর হোসেন।
'এখন আর আমার জীবন বলে কিছু আছে নাকি?' প্রশ্ন করেন তিনি।
'সকাল সাড়ে সাতটা থেকে রাত অব্দি শহরের প্রতিটা ফার্মেসি, হাসপাতাল, ডাক্তারের চেম্বারে দৌড়াতে হয় আমাদের। প্রতিদিনের রুটিন এটা। বাসায় ফিরতে ফিরতে গভীর রাত হয়ে যায়,' বলেন দুই সন্তানের এ বাবা।
'ভোর থেকে রাত, আমরা যানজট থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে যাই, কিন্তু যেখানেই আপনি যাবেন, জ্যাম আপনার পিছু ছাড়বে না,' তিনি বলেন।
আরেকজন বিক্রয় প্রতিনিধি মনিরুল ইসলাম (৩৩) বলেন, দ্রুতগামী মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না।
তিনি বলেন, 'কোম্পানি থেকেও চাপ বেড়েছে। অফিস যানজটের কথা শুনতেই চায় না। আমাদের বিক্রয় লক্ষ্য পূরণ না করতে পারলে চাকরি চলে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।'
তবে অনেকে মনে করছেন মোটরসাইকেল হচ্ছে ঢাকার রাস্তায় চলাচলের সবচেয়ে কার্যকরী সমাধান।
উত্তরায় নিয়মিত অফিসে পৌঁছানোর জন্য মিরপুর-১২-এর বাসিন্দা হাসান আরিফ বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল কিনেছেন।
'বাসে গেলে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা লাগে। কোনো কোনোদিন তো সকালে জলখাবার না খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়,' বলেন আরিফ। চাকরি ও সময়, দুটো বাঁচানোর জন্যই মোটরসাইকেলের ওপর ভরসা করতে হয়েছে তাকে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)-এর রমনা ট্রাফিক জোন-এর সহকারী কমিশনার রিফাতুল ইসলাম বলেন, যাত্রীরা মাঝেমধ্যে তাদের কাছে জানতে চান কোন রাস্তায় যানজট কম আছে।
'কিন্তু আমাদের কাছে কোনো উত্তর থাকে না। যেদিকেই যাওয়া হোক না কেন, যানজট একইরকম থাকবে,' তিনি বলেন।
যদিও আমি যথাসময়ে পৌঁছাতে পারি, কিন্তু তীব্র যানজটের ভেতরে এটাও কম বাজে অভিজ্ঞতা নয়।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, মগবাজারের বাসিন্দা রাহাত শিকদার বলেন, টঙ্গিতে অফিস থাকায় আমাকে যেতে-আসতে প্রতিবার চার ঘণ্টা করে সময় ব্যয় করতে হয়।
'এরপর আমি তেজগাঁও থেকে ছাড়া লোকাল ট্রেইনের খোঁজ পাই। তবে তারপরও এতেও দুই ঘণ্টা সময় লাগে। আমি ঢাকার ভেতরে একটা চাকরির সন্ধানে আছি,' বলেন তিনি।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে যানজট।
মনোবিজ্ঞানী রেহনুমা-ই-জান্নাত বলেন, 'টানা কয়েক ঘণ্টা যানজটে বসে থাকার ফলে খিটখিটে মেজাজ, মারমুখো আচরণ, ও উদ্বিগ্নতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে, যেগুলো মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে।'