বায়ুদূষণের সঙ্গে লড়ছে ধুলোর শহর ঢাকা
রোববার (১২ জানুয়ারি) বিশ্বের বিভিন্ন শহর-ভিত্তিক বায়ু মান তালিকায় ঢাকার বাতাসের মান আবারও সবচেয়ে খারাপ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এদিন সকালে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই)-এ ঢাকার বায়ু মানের স্কোর ছিল ২৩৯— যা 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' বায়ু পরিস্থিতি বলে বিবেচিত।
বছরের পর বছর ধরে রাজধানী ঢাকা বায়ুদূষণের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে; বিশেষ করে শীতের সময়ে ঢাকার বায়ু মান আরও খারাপ হয়। এ সময় বিশ্বব্যাপী বায়ু মানের তালিকায় খারাপের দিক থেকে টানা শীর্ষেই থাকে ঢাকা।
ধুলোবালি এবং যানবাহন ও ইঞ্জিনের কালো ধোঁয়া এই দূষণে ব্যাপক অবদান রাখছে।এতে রাজধানীর পল্টন, কাকরাইল, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, ধানমন্ডি, ফার্মগেট, গুলশান এবং মিরপুরের মতো এলাকাগুলো ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে।
গাছের পাতা থেকে শুরু করে ছোট ছোট গাছপালা, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, এমনকি দোয়েল চত্বর, শাপলা চত্বরের মতো আইকনিক কাঠামো এবং হাতিরপুল, ইস্কাটন ও বেইলি রোডের সব ভাস্কর্যই ঢেকে যাচ্ছে এই ধুলোর চাদরে। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলোর সৌন্দর্য ও স্থায়িত্বও কমে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধুলোবালি শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই তৈরি করে না, বরং শহরের সবুজ গাছপালা ও পরিচ্ছন্নতারও ক্ষতি করে। এ সত্ত্বেও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সিটি কর্পোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্তৃপক্ষকে বায়ুদূষণের ব্যাপারে তেমন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।
মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ডের বাটগাছ দুটির সবুজ পাতা ধুলোয় এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়ায় ধূসর রং ধারণ করেছে। বাস স্ট্যান্ডের আশেপাশের ভবনগুলোর দেওয়াল ও সাইনবোর্ডগুলোর রং ধারণ করেছে ধূসর। এমনকি, ধুলোর আস্তরণের কারণে ব্যানারগুলোর অনেক লেখাও বোঝা যায় না।
কথা হয় এ এলাকার এক কসমেটিকস দোকানী শফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, দিনে ২/৩ বার ঝাড়ু দিয়েও ধুলো থেকে নিস্তার পাচ্ছেন না। দোকানে রাখা পণ্যগুলোর উপরে ধুলোর আস্তরণ পড়ায় অনেক ক্রেতা সেগুলো নিতে চান না।
শফিকুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই এলাকায় এক মুহূর্তের জন্যও মাস্ক ছাড়া থাকা যায় না। কসমেটিকস এর ছোট ছোট পণ্য নিয়মিত তো মুছে রাখা যায় না। কিন্তু ক্রেতা এসে চাইলে সেগুলো বের করলেই দেখা যায় ধুলার আস্তরণ পড়ে পুরোনো পণ্যের মতো হয়ে আছে। আর বাসগুলো থেকে নিয়মিত কালো ধোয়ায় নিশ্বাস নেওয়াই কষ্টের।"
আশেপাশের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ, রাস্তা খড়াখুড়ি এবং ভাঙাচোড়া রাস্তা ধুলার সমস্যা দিন দিন বাড়িয়ে তুলেছে বলেও জানান তিনি।
ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের বাসিন্দা নীলিমা হক টিবিএসকে বলেন, "সাতমসজিদ রাস্তার রোড ডিভাইডারে সিটি কর্পোরেশন যে ফুলগাছগুলো লাগিয়েছিল, সেগুলো অনেক স্থানেই মারা যাচ্ছে। ধুলোয় আবৃত হয়ে এবং পরিচর্যা না হওয়ায় সবুজ গাছগুলো এখন ধূসর হয়ে আছে। রাস্তার পাশের বড় আকারের গাছগুলোর সবুজ পাতাগুলোও ধুলোয় ধূসর হয়ে আছে। এমনকি আমার বাসা দরজা-জানালা বন্ধ রাখার পরেও ফার্নিচারগুলো ধুলোয় আবৃত হয়ে থাকে।"
রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর ১১ নং রোডে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশের গাছগুলোসহ পার্কিং করা গাড়িগুলোতেও জমে আছে ধুলোর আস্তরণ। এক প্রাইভেটকারের ড্রাইভার আব্দুল মান্নান গাড়ি থামিয়ে গ্লাসের ধুলো পরিষ্কার করছিলেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "ধুলোর কারণে শুধু গাড়ির গ্লাসই বার বার মুছতে হয় না, এতে ইঞ্জিনেরও সমস্যা হচ্ছে প্রায়ই। তাই প্রতি সপ্তাহেই গাড়ি সার্ভিসিং করাতে হচ্ছে। গুলশান আর বনানী নয়, সর্বত্রই নির্মাণ কাজ, রাস্তা ভাঙা আছেই। লেকের পাড়ের ঘাস ও গাছসহ এমনকি লেকের পানিতেও ধুলার আস্তরণ পড়েছে।"
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "বায়ুদূষণ ও ধুলোর বিরুদ্ধে আমাদের কার্যক্রম চলমান আছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের সক্ষমতা অনেক কম। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা নিয়ম না মেনে নির্মাণকাজ পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন।"
"আর শীতকালে ধুলো হবে, গাছের পাতা ঝরে যাবে, সবুজ থাকবে না এটাই স্বাভাবিক," যোগ করেন তিনি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেলের সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার মো. খায়রুল বাকের বলেন, "আমাদের পানি ছিটানোর গাড়ি আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছি না। বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ কাজে যে পরিমাণ ধুলো হচ্ছে, সেটা আমরা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবো?"
"প্রাইভেটকাজগুলো আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। আর সিটি কর্পোরেশনের রাস্তা খোড়াখুড়ি করা ঠিকাদারদের বলা হয় যাতে পানি ছিটায় ও নিয়ম মেনে চলে। কিন্তু সবাই তো মানে না, সবাইকে নিয়ন্ত্রণও সম্ভব না আমাদের পক্ষে," যোগ করেন তিনি।
২০২২ সালে সেন্টার ফর অ্যাটমোস্ফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (ক্যাপস)-এর একটি গবেষণায় বলছে, ঢাকার গাছের পাতায় প্রতিদিন প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার কেজি ধুলো জমে। অর্থাৎ, প্রায় ১১২টির বেশি হাতির ওজনের সমান ধুলো গাছের পাতায় জমা হচ্ছে। এতে করে অক্সিজেন উৎপাদন কমছে ২০ শতাংশ।
বিগত দিনে এই ধুলোর পরিমাণ আরও বেড়েছে বলে জানিয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার টিবিএসকে বলেন, "ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে নির্মাণকাজের ধুলোবালি এবং যানবাহনের কালো ধোঁয়া। এগুলো নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা বিআরটিএ, রোডস এন্ড হাইওয়ে, সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থা বিগত দিনে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।"
তিনি বলেন, "বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১০০টি সরকারি প্রকল্প, কয়েক হাজার ব্যক্তিমালিকানাধীন ও বেসরকারি উন্নয়ন কাজ চলছে। যার কোনোটিই নির্মাণ বিধিমালা মেনে চলছে না। ঢাকার বায়ুদূষণের এই পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য আইনগতভাবেই সমাধানে আসতে হবে। এজন্য দরকার সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন।"
"বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল এবং পরিবেশ দূষণের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কার্যক্রম শুরু করেছে। এই কাজের ধারাবাহিকতা এবং বাস্তবায়ন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে ঘটাতে হবে," যোগ করেন তিনি।
রোববার একটি অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, "ঢাকাকে ধুলোবালির হাত থেকে রক্ষায় আগামী বর্ষা মৌসুমে অনাবৃত সড়ক বিভাজনে ঘাস লাগিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে। ধুলো কমাতে ভাঙা রাস্তাগুলোর মেরামত এবং অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি টাস্ক ফোর্স এবং অ্যাকশন গ্রুপ গঠনের কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে।"
তিনি আরও বলেন, "বায়ুদূষণ সমস্যার দীর্ঘমেয়াদে সমাধানের জন্য জ্বালানির মান উন্নতকরণ এবং শোধনাগার প্রক্রিয়া আধুনিকীকরণের প্রয়োজন। এ ধরনের পরিবর্তন বাস্তবায়নে সময় এবং উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ অপরিহার্য।"