বৈশাখ কেন বাংলাদেশের বাইরে ভিন্ন দিনে!
নববর্ষকে বাংলা ভাষাভাষীদের প্রধানতম উৎসব বলে গণ্য করা হয়। বাংলা পঞ্জিকার সূচনা এই দিনে। বলা হয়ে থাকে বাংলা অঞ্চলের ফসল উৎপাদন এবং খাজনা আদায়ের সাথে এই দিনটি সরাসরি সম্পর্কিত।
প্রতিবছর ১৪ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালিত হয়ে থাকে। দীর্ঘ ঐতিহ্য হিসেবে উৎসবটি ওপার বাংলাতেও পালিত হয় ধুমধামের সাথেই। তবে, আমাদের দেশের সঙ্গে একই দিনে হয়না। কখনো ১৪ই এপ্রিল আবার কখনো ১৫ই এপ্রিল তারিখে ওপার বাংলাতে নববর্ষ উদযাপিত হয়। আর বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ ১৪ এপ্রিল।
অনেক ঐতিহাসিকদের মতে, সম্রাট আকবর তার শাসনামলে এই বাংলা নববর্ষের প্রচলন করেছিলেন। তৎকালে হিজরি সাল অনুযায়ী খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু, হিজরি সন অনুযায়ী খাজনা আদায় করলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যেত কৃষকেরা সময়মতো ফসল ঘরে তুলতে পারত না। কারণ, হিজরি সন চন্দ্র পঞ্জিকা অনুযায়ী পরিচালিত হয়। চন্দ্রসনের ৩১ বছর হয় সৌর সনের ৩০ বছরের সমান।
আবার, ফসল কাটার সময় নির্ভর করতো সৌর সনের হিসাবের ওপর। এতে করে খাজনা আদায়ে একটা অসামঞ্জস্য অবস্থা তৈরি হতে থাকলো। এই সমস্যা সমাধানের জন্য চন্দ্রসন এবং সৌরসনের উপর ভিত্তি করে নতুন ধরনের একটি বর্ষগণনা ব্যবস্থা বিনির্মাণ করেন। নাম দেওয়া হয় 'তারিখ-ই-এলাহী'। সম্রাট আকবর মসনদে বসার পর এই নতুন ব্যবস্থা কার্যকর হয়। সেসময় চৈত্র মাসের শেষ দিনে কৃষকেরা খাজনা পরিশোধ করলে পরদিন অর্থাৎ, বৈশাখের প্রথম দিনে জমিদাররা তাদের মিষ্টান্ন খাওয়াতেন। এটিই পরবর্তীতে উৎসবে রূপ লাভ করে।
অবশ্য আকবরের আগে থেকেও বাংলায় ১২ মাসেরই প্রচলন ছিল। তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় একই দিনে নববর্ষ পালিত হতো। তখন বেশ কয়েকবার সৌর পঞ্জিকা সংস্কার করা হয়। যেমন, নবদ্বীপের পন্ডিত স্মার্ত রঘুনন্দন বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার করেছলেন। এরপর ১৯৫২ সালে ভারত সরকার মেঘনাদ সাহাকে প্রচলিত পঞ্জিকা শকাব্দ সংস্কার করতে বলেন। সংস্কারকৃত শকাব্দ অনুযায়ী বাংলা নববর্ষ ছিল ১৪ই এপ্রিল।
১৯৬৩ সালে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লার নেতৃত্বে বাংলা একাডেমীও পঞ্জিকা সংস্কারে হাত দেয়। নতুন করে তৈরি হওয়া পঞ্জিকা অনুযায়ী বাংলা সনের প্রথম ০৫ মাস অর্থাৎ, বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাস হবে ৩১ দিনের, আর বাকী ০৭ মাস, আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস ৩০ দিনের হবে।
স্বাধীনতার পরে ১৯৯৫ সালে সংস্কারকৃত পঞ্জিকা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হলো। এসময় খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকার লিপ ইয়ারে ফাল্গুন মাস ৩১ দিনের হবে বলে ধরা হয়। এতে করে যে বছর খ্রিষ্টীয় সনে লিপ ইয়ার, সে বছর বাংলা সনেও লিপ ইয়ার হয়ে গেলো। এই পঞ্জিকার ফলে পহেলা বৈশাখের তারিখ '১৪ই এপ্রিল' আর কখনো হেরফের হবার সম্ভাবনা নেই।
কিন্তু, ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের পঞ্জিকা মূলত সৌরসন গণনা করে তৈরি করা হয়েছে। সেই পঞ্জিকা অনুযায়ী 'লিপ ইয়ার' ছাড়া পহেলা বৈশাখের দিন হিসাবে ১৫ই এপ্রিল নির্ধারিত হয়ে থাকে।
বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক প্রয়াত ফরহাদ খান বৈশাখ নিয়ে এক লেখায বলেন, "বাংলাদেশে চন্দ্রসন এবং সৌরসন, উভয় পঞ্জিকাই প্রচলিত আছে। বাঙ্গালী হিন্দু এবং মুসলিমদের ধর্মাচরন ভিন্ন। বাঙালি হিন্দুদের তিথি, নক্ষত্র, দণ্ড, পল, হিসেব করতে হয়। এখন যে পঞ্জিকা বাংলাদেশ ব্যবহার করছে, তাতে হিন্দুদের ধর্ম পালনে অসুবিধা হয়। তাই এখানে সমান্তরালে ধর্মীয় ক্যালেন্ডারও আছে। বাংলা সন একইসাথে চন্দ্রসন এবং সৌরসন। বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল একটি অসাম্প্রদায়িক ধর্ম নিরপেক্ষ উৎসবের এবং দিনের। পহেলা বৈশাখকে অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসাবেই দেখা হয়েছে।"
ওদিকে পশ্চিমবঙ্গে এ ধরনের কোনো সংস্কার হয়নি, ফলে ওপাড়ে পয়লা বৈশাখ আমাদের মতো একদিনে পালন হয় না।