দখল-দূষণ আর পলিতে মৃতপ্রায় সুরমা নদী
দেখে মনে হতে পারে একটি ড্রেন, যাবতীয় আবর্জনা ফেলার স্থান কিংবা ময়লার ভাগাড়। এমনই দশা এখন সিলেট নগরের বুক চিরে বয়ে চলা সুরমা নদীর। যেন নগরীর সব কদর্যতা ধারণ করে আছে সুরমা।
নদীর বুকজুড়ে জেগেছে চর। একপাশে সরু খালের মতো পানির প্রবাহ থাকলেও পানির উচ্চতা সেখানে হাঁটু সমান। হেঁটেই সেই নদী পাড়ি দিচ্ছেন লোকজন। বড় যান, এমনকি দূরে থাকা ডিঙি নৌকাও আটকে যাচ্ছে চরে। আর বালুময় চরের ওপর ক্রিকেট খেলছে স্থানীয় শিশুরা। রোববার নগরীর কুশিঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা যায় সুরমা নদীর এই করুণ দৃশ্য।
প্রায় ২৪৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরের সুরমা দেশের দীর্ঘতম নদী। ভারতের বরাক নদী থেকে সিলেটের জকিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিলিত হয়েছে এ নদী। দীর্ঘতম এই নদী এখন পানিহীন, মৃতপ্রায়।
পলি জমে ভরাট হয়ে পড়েছে তলদেশ। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুরমা হয়ে পড়ে বালুভূমি। কেবল নগরীর কুশিঘাট নয়, এ নদীর বেশিরভাগ স্থান এখন শুকিয়ে খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। জকিগঞ্জ থেকে সিলেট পর্যন্ত নদীতে শতাধিক স্থানে জেগে উঠেছে দুই তীরবিস্তৃত চর। দক্ষিণ সুরমা, গোলাপগঞ্জ, কানাইঘাট, টুকের বাজারসহ কয়েকটি স্থানে নদীর জেগে ওঠা চরে সবজি চাষও করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এমনিতেই পলি জমে নদী পরিণত হয়েছে খালে। তার ওপর আছে দখল। নদীর দুই তীর দখল করে গড়ে উঠেছে অসংখ্য স্থাপনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবেই, সিলেটে সুরমার দুই তীর দখল করে রেখেছেন ১১১ দখলদার। তারা গড়ে তুলেছেন দুই শতাধিক স্থাপনা। তবে পরিবেশ কর্মীদের হিসাবে দখলদারের সংখ্যা আরও বেশি।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে এসব দখলদারদের উচ্ছেদ করতে শুরু হয় সমন্বিত অভিযান। তবে কিছুদিন পরই তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে আবারও দখলদাররা জেঁকে বসেছে সুরমার দুই তীরে।
অব্যাহত দখল, দূষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পলির কারণে হুমকির মুখে দেশের দীর্ঘতম এই নদী।
সিলেট নগরের কুশিঘাট থেকে টুকের বাজার প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা। এই পুরো এলাকাজুড়েই সুরমা নদীকে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে। আর দখল করে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে দুই তীরে। বাসা-বাড়ি-কলকারখানার দূষিত বর্জ্যের পাশাপাশি সরাসরি আবর্জনাও ফেলে দেয়া হচ্ছে এই নদীতে।
সুরমা নদীর কুশিঘাট থেকে টুকের বাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেছে সুরমা। নদীর পানিতে ভাসছে অসংখ্য ময়লা-আবর্জনার স্তুপ। নগরীর কাজীর বাজার মাছের আড়তে গিয়ে দেখা যায় ককশিট ভাসছে নদীতে। বাজারের সকল ময়লা আবর্জনা নদীতে সরাসরি ফেলে দেওয়া হয়। মাছের খাঁচা, ককশিট ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের আবর্জনা ভেসে যেতে দেখা গেছে নদীর ওপর দিয়ে। কাজীর বাজারের মাছের আড়তের শৌচাগারের পাইপ সরাসরি নামানো হয়েছে নদীতে। সরজমিন দেখা গেছে, নদীতে গিয়ে পড়ছে শৌচাগারের ময়লা। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বস্তির টয়লেটের পাইপও নদীতে সরসরি নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
একইভাবে সিলেটের পাইকারী বাজার কালীঘাট এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, পেঁয়াজ রসুনের ময়লা আবর্জনা ভেসে যাচ্ছে নদীর ওপর দিয়ে। কালীঘাটের সকল আবর্জনা সরাসরি নদীতে ফেলা হয় বলে জানালেন ওই এলাকার পরিচ্ছনতা কর্মী আবুল হোসেন।
তিনি জানান, সিটি কর্পোরেশনের গাড়ি এসে যে আবর্জনা নিয়ে যায় তার চেয়ে ৫ গুণ বেশি আবর্জনা ফেলা হয় নদীতে। তিনি বলেন, নদীর পানি দিন দিন দূষিত হয়ে পড়ছে। ওই পানি হাতে লাগলে চুলকায়। একইভাবে কুশীঘাট এলাকা থেকে টুকের বাজার সবখানেই দেখা গেছে নদীর পানি দূষিত করে আবর্জনা সরসরি পানিতে ফেলা হচ্ছে।
নগরীর মাছিমপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গৃহস্থালির যাবতীয় ময়লা ফেলে দেওয়া হচ্ছে নদীতে। আবার পাশেই দলবেঁধে নদীতে গোসল করছেন এলাকার লোকজন।
নগরীতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠা ও পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায়ই এমনটি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। আবার নগরবাসীর সচেতনতার অভাবকেও দায়ী করেছেন তারা।
এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, "নদীর এ চিত্র আমাকেও পীড়া দেয়। আমাদের অফিসটাও নদীর পাশেই।"
"সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে। তারা চাইলে নদীর পানি দূষণ রোধ ও আবর্জনা ফেললে ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু তারা সেটি করছে না। তারা যদি ব্যবস্থা নেয়, তাদেরকে আমারাও সহযোগিতা করবো", যোগ করেন এমরান।
সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান বলেন, "আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন হচ্ছে না। সবার আগে অভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। সচেতন হতে হবে। সচেতন হলেই আমাদের নদী রক্ষা করা সম্ভব।"
পরিবেশ অধিদপ্তরের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "এটি তাদের দায়িত্ব। তারা এ ব্যপারে ব্যবস্থা নিতে পারে।"
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) অ্যাডভোকেট শাহ শাহেদা বলেন, "১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষন আইন অনুযায়ী নদী, খাল, পুকুর ভরাট ও দূষণ করা যাবে না। এমনকি শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে ২০১৩ সালের পানি অধিকার আইনেও পানি নিষ্কাশনে বাধা দেওয়া যাবে না বা দূষণ করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, "সিলেট সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ময়লা আবর্জনা ফেলে নদীর পানি দূষণ করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি। এসব তথ্য সংগ্রহ হলেই বেলার পক্ষ থেকে আইনী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।"
বন্ধ উচ্ছেদ অভিযান
২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সুরমা নদীর দখলদারের চিহ্নিত করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এরমধ্যে সিলেট নগরে সুরমা নদীর ১১১ দখলদারকে চিহ্নিত করা হয়। তারা নদীর ৩ হাজার ৬০০ মিটার জায়গা দখল করে রেখেছেন। দখলদাররা নদীর তীর দখল করে নির্মাণ করেছেন স্থাপনা। এসব অবৈধ স্থাপনায় দোকান তৈরি করে চালের আড়ৎ, মাইকের দোকান, কাপড় ও জুতার দোকান, সেলুন, ফার্নিচার, স্বর্ণের দোকান, ফাস্টফুডের দোকান, মাংসের দোকান খোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় পাউবোর প্রতিবেদনে। তবে প্রকৃত চিত্র এর চেয়ে আরও ভয়াবহ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
তালিকা করার পর, ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বরে সারাদেশে একযোগে নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের অভিযান শুরু হয়। সিলেট নগরসহ কয়েকটি উপজেলায় চলে এই অভিযান । তবে এর একমাস পরই উচ্ছেদ অভিযান মাঝপথে থেমে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উচ্ছেদ অভিযান থেমে যাওয়ার পর দখলমুক্ত হওয়া অনেক জায়গায় আবারও অবৈধ স্থাপনা বসিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে।
এ ব্যাপারে পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার জানান, প্রকৃত দখলদারের সংখ্যা তালিকার চেয়েও বেশি তাতে সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, "উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হয়নি। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। অভিযান সব সময় চলবে।"
উচ্ছেদকৃত অনেক জায়গায় আবার নতুন করে দখল হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "কিছু কিছু জায়গায় পুনরায় দখল হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। যেকোনো সময় সেগুলো আবারও উচ্ছেদ করা হবে।"
সুরমা নদীর এই বেহাল দশা প্রসঙ্গে নদী সুরক্ষার আন্তর্জাতিক জোটের সদস্য আব্দুল করিম কিম বলেন, "সুরমা এখন মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হয়েছে। অব্যাহত দখল ও দূষণে এই নদী এখন অস্তিত্ব সংকটে। নদীর দূষণ ও দখল ঠেকাতে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।"
আটকে আছে খননের উদ্যোগ
ভরাট হয়ে যাওয়া সুরমা নদী খননের দাবি দীর্ঘদিনের। তবে সমীক্ষা হলেও এখন পর্যন্ত নদী খননের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভরাট হয়ে পড়েছে এ নদীর উৎসমুখও। নদীর উৎসমুখের ৩২ কিলোমিটারে জেগেছে ৩৫টি চর। দুই দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় উৎসমুখ খননের কাজ শুরু করতে প্রয়োজন যৌথ নদী কমিশনের সিদ্ধান্ত। আর কমিশনের সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আটকে আছে খনন কাজ।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, সুরমা নদী খননে ২০১২ সালে সিলেট থেকে একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এরপর নদী খননে সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষার পর নদী খননে উদ্যোগ নেওয়ার কথা সে সময় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। তবে এরপর এ ব্যাপারে আর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
২০১৭ সালে ফের সুরমা নদী খননের জন্য সমীক্ষা চালানো হয়। তবে এখন পর্যন্ত এই সমীক্ষা প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আটকে আছে খনন কাজ।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেট কার্যালয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ শহীদুজ্জামান সরকার বলেন, নদী খননে সমীক্ষা হলেও সমীক্ষা প্রতিবেদন এখনও প্রকাশিত হয়নি। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো প্রকল্পও নেওয়া হয়নি।"
তবে দ্রুতই সুরমা নদী খননের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
নদীর উৎসমুখ খনন করার প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে তিনি বলেন, "উৎসমুখ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালে বরাক থেকে আসা পানির ৫ থেকে ১০ শতাংশ সুরমায় প্রবেশ করে। আর অন্যন্য মৌসুমে কোনো পানিই প্রবেশ করে না। সব পানি চলে যায় কুশিয়ারায়। ফলে বছরের প্রায় আট মাসই পানিশূন্য থাকে সুরমা।"