দুই বছর পর ফের চাঙা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা ব্যবসা
করোনা মহামারিতে গত দুই বছর লোকসানের পর আবারও ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে ব্রাহ্মনবাড়িয়ার পাদুকা শিল্প।
ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে পুরো রমজান মাস জমজমাট থাকে পাদুকা ব্যবসা। ফলে বছরের এই সময়টাকে পাদুকা ব্যবসার মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া ঈদুল আজহাতেও চাহিদা থাকে জুতার।
তবে, গত দুইবছর করোনা মহামারির কারণে ব্যবসা করতে না পারলেও কারখানা চালু রাখতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের লোকসান গুণতে হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। আশার কথা হলো- আবারও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্ভাবনাময় পাদুকা শিল্প।
আসন্ন ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে বাজারে জুতার চাহিদা মেটাতে এখন রাত-দিন কাজ করছেন শ্রমিকরা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে জুতা নেওয়ার জন্য পাইকাররা আসছেন কারখানাগুলোতে। এবার অন্তত ২৫ কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে ব্যবসায় চাঙাভাব বিরাজ করলেও জুতা তৈরিতে ব্যবহৃত কেমিক্যালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং নিয়ে ব্যবসায়ীরা বিপাকে পড়েছেন। গতবছর কেমিক্যাল ছিল ২২০ টাকা, সেটি এবার ৩২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। কেমিক্যোলের মূল্যবৃদ্ধি ও লোডশেডিং এর সমস্য না থাকলে এবারের মৌসুমে ভালো ব্যবসা করে করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল ব্যবসায়ীদের।
জুতার ব্যবসায়ীদের দেওয়া তথ্যমতে, ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম মাহমুদ আলী নামে ভারতীয় এক ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাদুকা কারখানা তৈরি করেন। এরপর থেকেই বিস্তৃত হতে থাকে সম্ভাবনাময় পাদুকা শিল্প। প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এ শিল্পে।
বর্তমানে জেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে একশ পাদুকা কারখানা সচল আছে। এর মধ্যে ১৯টি কারখানায় জুতা তৈরি হচ্ছে মেশিনে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পাদুকা কারখানায় তৈরি জুতা।
প্রতি মৌসুমে বড় কারখানাগুলোর একেকটি ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করে। আর ছোট কারখানাগুলো থেকে বাজারজাত হয় ৮-১০ লাখ টাকার জুতা। বাজারের চাহিদা বিবেচনায় রমজান মাসে কারখানাগুলোর উৎপাদন বাড়ে দ্বিগুণ। রাত-দিন কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। তবে করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে সরকারি নির্দেশনায় কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের। ফলে ওই বছর ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় ব্যবসা করতে পারেননি তারা।
এছাড়া ২০২১ সালেও সংকটে ছিল পাদুকা ব্যবসা। প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি লকডাউনের কারণে কারখানায় উৎপাদিত জুতা বাজারজাত করা যায়নি। ফলে তখন প্রতিটি কারখানার উৎপাদন অর্ধেকের নিচে নেমে আসে। ব্যবসা না হলেও স্থায়ী শ্রমিকদের বেতন, কারখানার ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ আনুষাঙ্গিক সকল ব্যয়ই মেটাতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
এবার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আবারও কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরেছে শ্রমিকদের মাঝে। বর্তমানে বড় কারখানাগুলোতে প্রতিদিন ৩-৪ হাজার জোড়া জুতা তৈরি হচ্ছে। আর ছোট কারখানাগুলোতে গড়ে তৈরি হচ্ছে ৩০০ জোড়া। সবগুলো কারখানাতেই সকাল থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত চলে জুতা তৈরির কাজ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের শ্রমিক সোহেল মিয়া জানান, গত দুই বছর কাজ না থাকায় বাড়িতে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে চরম অর্থকষ্টে দিন কেটেছে তার। সংসার চালাতে বাধ্য হয়ে তিনি দিনমজুরি করেছেন। তবে ঈদুল ফিতরকে ঘিরে এখন বাজারে জুতার চাহিদা মেটাতে রাত-দিন করছেন। শ্রমিকদের এখন দম ফেলারও ফুরসত নেই। বছরের এই সময়টাতে অতিরিক্ত কাজ করে বেতনের বাইরে তিনি ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান।
আরেক শ্রমিক মো. উজ্জল জানান, রমজান মাস শুরুর পর থেকেই তাদের কারখানার ৮০-১০০ জন শ্রমিক রাত-দিন মিলে কাজ করছেন। সারাবছর এই সময়টার জন্যই অপেক্ষা করেন তারা। বেতন-মজুরির বাইরে অতিরিক্ত কাজ করে যে টাকা পান, সেটা দিয়েই পরিবারের জন্য ঈদের কেনাকাটা করেন বলে জানান তিনি।
সেভেন স্টার ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপক মো. আল আমিন বলেন, "করোনার কারণে গত দুই বছর কারখানায় অচলাবস্থা বিরাজ করেছে। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ব্যবসার অবস্থা এখন ভালো। আমাদের কারখানায় শতাধিক শ্রমিক কাজ করছে। প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজার জোড়া জুতা তৈরি হচ্ছে।"
এবার প্রায় ১ কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করার আশা করেন তিনি।
অ্যাক্টিভ ফুটওয়্যারের পরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, গত দুই বছরে কারখানা চালু রাখতে গিয়ে ৮-১০ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে তাদের। তবে এবার করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ভালো ব্যবসা হওয়ার আশা করছেন তিনি। কারখানায় জুতার উৎপাদনও বেড়েছে। এবার ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকার জুতা বিক্রির টার্গেট রয়েছে তার।
এ ব্যাপারে জেলা পিও ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ বলেন, "চাহিদা থাকায় উৎপাদন বেড়েছে। আমাদের টার্গেট আছে এবার ২০-২৫ কোটি টাকার জুতা বাজারজাত করার। তবে এবার কেমিক্যালের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের লোডশেডিং ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
"গতবছর যে কেমিক্যাল ২২০ টাকায় কিনেছি, সেটি এবার ৩২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এতে করে উৎপাদন খরচ বাড়লেও আমরা জুতার দাম বাড়াতে পারছি না। এছাড়া প্রতিদিন ২-৩ ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকে না। এতে করে উৎপাদন ব্যহত হয়। এ দুই সমস্যা না থাকলে করনোয় হওয়া ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারতাম," যোগ করেন তিনি।