অস্ত্রধারী ১৭ জন চিহ্নিত, শিগগিরই গ্রেপ্তার: ডিবি
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেট ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষ-হামলার ঘটনায় সরাসরি হামলায় অংশ নেয়া অস্ত্রধারী কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে, কুরিয়ার ডেলিভারিম্যান নাহিদ ও দোকানকর্মী মোরসালিন হত্যায় অংশ নেয়া অস্ত্রধারী অন্তত ১৭ জনকে চিহ্নিত করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। নাহিদ ও মোরসালিন হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা দুটি তদন্ত করছে ডিবি। গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা এখন পর্যন্ত হামলায় অংশ নেয়া ও নির্মমভাবে কুপিয়ে খুনের ঘটনায় অন্তত ১৭ জনকে চিহ্নিত করেছেন। ঘটনার আশেপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ, সংঘর্ষের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী, নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদে তাদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পেরেছে গোয়েন্দা পুলিশ।
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষে ১৭ জন দেশীয় অস্ত্রধারী ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন। তাদের মধ্যে নয়জন ছিলেন হেলমেটধারী। তাদের হাতেও ছিল অস্ত্র। দুই দিনের সংঘর্ষে এক জোট হয়ে এ-মাথা থেকে ও-মাথা দাপিয়ে বেড়িয়েছিলেন তারা।
হেলমেটধারীদের ধাওয়াতেই কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হোসেন রাস্তায় পড়ে যান। পেছন থেকে এসে অন্য একজন উপর্যুপরি নাহিদকে কোপাতে থাকেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিও, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, ক্যামেরার ফুটেজ ও তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ওই ১৭ যুবককে শনাক্ত করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের একটি সূত্র বলছে, তাদের অধিকাংশই ঢাকা কলেজের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থী। কয়েকজনের আছে রাজনৈতিক পরিচয়ও। তাদের নাম-ঠিকানা ও পারিবারিক পরিচয় সবই সংগ্রহ করেছেন তারা। তবে এখনই তাদের গ্রেপ্তার বা পরিচয় প্রকাশে আগ্রহী নয় পুলিশ। কিন্তু সরাসরি হামলায় অংশ নেয়া সন্দেহভাজনদের বাদ দিয়েই মামলার তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে গেছে বলে দাবি করেছে দুই মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম মুঠোফোনে বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে বেশ কিছু তথ্যও তাদের হাতে এসেছে। কিন্তু অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তবে কবে নাগাদ তাদের গ্রেপ্তার করা যাবে, সে বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা। এমনকি শুধু কেন বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার বা মামলায় আসামি করা হয়েছে সে বিষয়েও কোন কথা বলতে চাননি তিনি। একইভাবে প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান একেএম হাফিজ আক্তারও। তিনি বলেছেন, অস্ত্রধারীদের তারা শনাক্ত করেছেন, যাচাই-বাছাই শেষে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে শিগগিরই তাদের গ্রেপ্তার করা হবে। তিনি বলেছেন, হামলায় উসকানি দেয়া ও ইন্ধনের বিষয়ে পুলিশের সুস্পষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ২৪ জন নামীয় আসামি করা হয়েছে, তারা কোন দলের তা দেখা হয়নি।
ঘটনার পর থেকেই আতঙ্কে আছেন নিউমার্কেটের সাধারণ ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এরকম বেশ কয়েকজন কোনো রাজনৈতিক তদন্ত নয়, সঠিক তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে আহ্বান করেছেন।
গত সোমবার রাত ১২টার দিকে নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়ান। পরদিন দিনভর সংঘর্ষ চলে ওই এলাকার ব্যবসায়ী, দোকান কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এ ঘটনায় নাহিদ হোসেন ও মোহাম্মদ মোরসালিন নামের দুই তরুণের মৃত্যু হয়েছে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন অন্তত ৪০ জন। সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ভাঙচুর ও জখম করার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করে। আর দুই তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় তাদের পরিবার দুটি হত্যা মামলা করেছে।
সব মিলিয়ে এ ঘটনায় চার মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৭০০। গত চার দিনের অভিযানে এখন পর্যন্ত এসব মামলায় মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। তিনি নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি এবং বর্তমানে বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ মকবুল হোসেন।
এদিকে মকবুল হোসেনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিএনপি পুলিশের নিন্দা জানিয়েছে এবং বিএনপিকে দোষারোপ করে তাদের 'ব্যর্থতা ঢাকতে' চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেছে।
পুলিশ নিউমার্কেট এলাকার সংঘর্ষে জড়িত আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল।
গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনের মুক্তি এবং সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের করা 'মিথ্যা মামলা' প্রত্যাহারের দাবিতে আগামী ২৬ এপ্রিল (মঙ্গলবার) দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ করবে দলটি।
দলের চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এ কর্মসূচি ঘোষণা করে জানান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিউমার্কেট এলাকায় সহিংসতার ঘটনা তদন্ত করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটি মকবুলকে মুক্তি দিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানায়।
ফখরুল আরো বলেন, প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার না করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের ২৪ নেতাসহ ১২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে যে সেদিনের সংঘর্ষে ছাত্রলীগের 'ক্যাডার'রা জড়িত ছিল।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন মনে করছেন, বিষয়টি রাজনৈতিক মামলার দিকে মোড় নিচ্ছে। তারা চান মামলাটি রাজনৈতিকভাবে তদন্ত না হয়ে আসল ঘটনা উঠে আসুক। যারাই হামলাকারী তাদেরই উপযুক্ত বিচার হোক।
যদিও গতকাল এক অনুষ্ঠানে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ বলেছেন, নিউমার্কেটের ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক বিবেচনায় মামলা হয়নি, আর হবেও না।
তিন দিনের রিমান্ডে বিএনপি নেতা মকবুল
রাজধানীর নিউমার্কেটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা দেয়া, মারধর ও ভাঙচুরের অভিযোগে করা মামলায় নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মকবুল হোসেনকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার ঢাকা মহানগর হাকিম মামুনুর রশিদ এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পুলিশ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংঘর্ষের সূত্রপাত নিউমার্কেটের ভেতরে থাকা ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্টফুড নামের দুই দোকান কর্মচারীর দ্বন্দ্ব থেকে। সেই দোকান দুটি সিটি করপোরেশন থেকে মকবুলের নামে বরাদ্দ রয়েছে। রফিকুল ইসলাম ও শহিদুল ইসলাম নামে দুজন এই দোকান চালাতেন। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, মকবুল হোসেনের দোকান নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। তিনি এই সংঘর্ষে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তিনিই এই মামলার এজাহারনামীয় এক নম্বর আসামি। এই ঘটনার আরও উসকানিদাতা ও অন্তত ২৩ জন জড়িত। তাদের শনাক্ত করার জন্য রিমান্ডে নেয়া প্রয়োজন।
আতঙ্কে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা
এদিকে সংর্ঘষের চার দিন পর নিউমার্কেট ও আশপাশের মার্কেটগুলোর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ঢাকা কলেজ এলাকায় কিছুটা চাপা আতঙ্ক আছে। ঈদের ছুটি হওয়ার কারণে হলগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এখনো কিছু শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছেন। কিন্তু তারা আছেন পুলিশি হয়রানির আতঙ্কে। কেননা সংঘর্ষের ঘটনায় চার মামলায় ঢাকা কলেজেরই অন্তত ১ হাজার ১০০ শিক্ষার্থীকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক এ টি এম মইনুল হোসেন বলেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। তবে তারা পুলিশ প্রশাসনকে অবহিত করেছেন। অন্যায় বা সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া যেন কোনো শিক্ষার্থীকে হয়রানি না করা হয়।