রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর: আজও সন্তানের অপেক্ষায় কাটে অনেক মায়ের রাত
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও বাসা থেকে বাবা-মা, স্ত্রী আর অবুঝ দুই সন্তানের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ কর্মস্থল রানা প্লাজায় যান মোঃ শামীম। কথা ছিলো ডিউটি শেষ করে আবার ফিরে যাবেন মায়ের বুকে, পরম ভালোবাসায় বুকে জড়িয়ে ধরবেন অবুঝ দুই শিশুকে। কিন্তু সেই যে বিদায় নিলেন, আজও ফেরা হয়নি শামীমের। এই দিনটি আসলে ছলছল চোখে সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন ষাটোর্ধ্ব মা হাজিরন বেগম। জানেন ফিরবে না সন্তান, তবু মায়ের অপেক্ষা যেন শেষ হয়না।
পোশাক শিল্পের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্র্যাজেডি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল এর পর ৯টি বছর কেটে গেলেও হাজিরন বেগমের মত বহু মা আজও অপেক্ষায় থাকে সন্তানের। ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় আহত হয়ে এখনো দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে অনেক শ্রমিক, যারা কর্মক্ষমতা হারিয়ে অর্থকষ্টে কোনোমতে বেঁচে আছেন দুর্বিষহ সেই স্মৃতিকে বুকে নিয়ে।
রোববার (২৪শে এপ্রিল) সকালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর পূর্তি উপলক্ষে সাভারে রানা প্লাজার সামনে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের স্বরণে অস্থায়ীভাবে নির্মিত বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের স্বজন, আহত শ্রমিক, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনসহ বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠন। সকাল থেকে এদিন একে একে ফুল দিয়ে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তারা। এসময় বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, আহত শ্রমিক ও নিহত শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষ থেকে দ্রুত বিচারের মাধ্যমে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ বিচারসহ বিভিন্ন দাবি তুলে ধরা হয়।
সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যাদের কারণে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা, তাদের মধ্যে রানা ব্যতিত বাকিরা সবাই আজ আয়েশী জীবন যাপন করছে। দীর্ঘ ৯ বছরেও এই মামলায় দোষীদের বিচার নিশ্চিত না হওয়ায় এসময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ২৭টি শ্রমিক সংগঠন নিয়ে গঠিত গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের সাভার, আশুলিয়া, ধামরাই আঞ্চলিক কমিটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির দীর্ঘ ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও নিশ্চিত করা যায়নি দোষীদের বিচার। এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে যে যেসব মায়েরা আজও সন্তান হারিয়ে, সন্তানেরা বাবা-মাকে হারিয়ে, পঙ্গুত্ব বরণ করে যেসব শ্রমিক আজ দূর্বিষহ জীবন যাপন করছে, তারা আজও নিশ্চিত নন ইচ্ছাকৃত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সাথে জড়িতদের বিচার তারা দেখে যেতে পারবেন কিনা, এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারেনা।"
এসময় তিনি এ ঘটনায় দায়ীদের দ্রুত বিচারের মাধ্যমে সর্বোচ্চ বিচার নিশ্চিত করার পাশাপাশি আহত সকল শ্রমিকদের স্থায়ী পুনর্বাসন, ২৪ এপ্রিলকে জাতীয়ভাবে পোশাক খাতের শোক দিবস ঘোষণা করাসহ রানা প্লাজার জমিটি অধিগ্রহণ করে শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানান।
একই রকম দাবি জানিয়ে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক খায়রলি মামুন মিন্টু টিবিএসকে বলেন, পোশাক শিল্পের ইতিহাসে এতবড় ট্র্যাজেডি আর নেই, অথচ দীর্ঘ ৯ বছরের এর সাথে জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার।
তিনি বলেন, "এভাবে চলতে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আদতেও দোষীদের বিচার দেখে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে, আমরা দ্রুত এই মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ করে দোষীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতের দাবি জানাই।"
তিনি আরও বলেন, যেই পোশাক খাতের শ্রমিকদের রক্তে-ঘামে দেশ আজ উন্নতির পথে এগোচ্ছে, যাদের ত্যাগে উপর নির্ভর করছে দেশের অর্থনীতি, আজ তারাই অবহেলিত। রানা প্লাজায় আহত যেসকল শ্রমিক পঙ্গুত্ব বরণ করে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য এখনো কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
এদিন রানা প্লাজার সামনে এসে পুরোনো সেই ভয়াবহ স্মৃতিকে স্মরণ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক নুরবানু টিবিএসকে বলেন, "সেদিন মেরুদণ্ডসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাত কোনোমতে বেঁচে ফিরেছি ঠিকই, কিন্ত সত্যিকার অর্থে বেঁচে আছি কিনা জানিনা।"
তিনি বলেন, "দুর্ঘটনায় কর্মক্ষমতা হারিয়েছি, কিন্তু আজও কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি। কর্মক্ষমতা হারানোর কারণে স্বামীও ছেড়ে চলে গিয়েছে, তিন সন্তান নিয়ে আমি এখন বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে বোঝা। আর কতদিন এভাবে বোঝা হয়ে থাকবো, সরকারের কি কোন দায়িত্ব নেই আমাদের প্রতি?"
বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অরবিন্দু বেপারী বিন্দু বলেন, এটিকে কোন দুর্ঘটনা বলা যাবেনা, এটি একটি হত্যাকাণ্ড।
"সেদিন যদি ওই ভবনে থাকা কারখানার মালিকরা ও ভবন মালিক রানা জোড় করে শ্রমিকদের কাজে যোগদানে বাধ্য না করতো তবে এতগুলো তাজা প্রাণের নির্মম পরিণতি দেখতে হতো না।"