শিল্পায়ন বদলে দিচ্ছে ত্রিশালের গ্রামীণ অর্থনীতি
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধানীখোলা ইউনিয়নের বাসিন্দা নাসরিন আক্তার। বাবা দিন মজুর, দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সবার বড় তিনি। বাবা পড়াশোনার খরচ জোগাতে পারতেন না, তাই স্কুলে যাওয়া হয়নি কখনোই। বেড়ে উঠেছেন তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যে।
কিন্তু নাসরিনই এখন সংসারের হাল ধরেছেন। ত্রিশালের রাঘামারা এলাকায় স্থাপিত হওয়া কনজুমার নিটেক্স লিমিটেডে দুই বছর আগে চাকরি নেন তিনি।
নাসরিন এখনও ওভার টাইমসহ মাসে প্রায় পনেরো হাজার টাকা বেতন পান। এই অর্থে দারিদ্র্য অনেকখানি দূর হয়েছে তার পরিবারে। বছরখানেক আগে এক সহকর্মীকে বিয়ে করেন তিনি।
'এক বান্ধবীর সহযোগিতায় চাকরি শুরু করি। প্রায় তিন হাজার কর্মী এখানে কাজ করে। ফ্যাক্টরিগুলোতে যারা কাজ করে তাদের বড় অংশই আমার মতো। স্বামীও যেহতু আয় করেন, তাই এখন খানিকটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি। নিজের সংসারের পাশাপাশি বাবা-ভাইদেরও সহযোগিতা করছি,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন নাসরিন।
কনজুমার নিটেক্সের মতো শিল্পকারখানাগুলো বদলে দিয়েছে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র। এই কারখানাগুলো এ উপজেলায় কৃষির বাইরে অকৃষি খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করেছে। যেখানে সমান তালে কাজ করছেন নারী-পুরুষ।
ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ অরগানাইজেশনের (এডরো) নির্বাহী পরিচালক মো.তানজিল হাসান বলেন, 'ত্রিশালে গ্রামীণ জীবনে শিল্পের অবদানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতা দূর করতে বড় সহায়ক শক্তি হচ্ছে। যখন মানুষের উপার্যন ক্ষমতা বাড়ে, তখন অর্থনীতির চাকাও ঘুরতে থাকে। যেহেতু টাকার লেনদেন বাড়ছে, তাই গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানও পরিবর্তন হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, এখন এলাকাতেই কাজের সুযোগ থাকায় চাকরির সন্ধানে মানুষের রাজধানীতে পাড়ি দেওয়ার হারও কমে আসছে।
বিশাল বিনিয়োগ, বড় কর্মসংস্থানের সুযোগ
কয়েক বছর আগে ত্রিশাল উপজেলার মোক্ষপুর ইউনিয়নে স্থাপন করা হয়েছে আকিজ সিরামিকস লিমিটেডের কারখানা। টাইলস, স্যানিটারি পণ্য, পার্টিকেল বোর্ড ও খাবার প্যাকেজিংয়ের বিওপিপি উৎপাদন করা হয় এখানে।
আকিজ সিরামিকসের অ্যাডমিন ম্যানেজার (এইচআর) মো. মামুন আখতার বলেন, 'আমাদের কারখানায় প্রায় চার হাজার শ্রমিক কাজ করছে। তাদের ৪০ শতাংশই স্থানীয় যুবক-যুবতী। সবার জন্য ইনক্রিমেন্ট, প্রভিডেন্ট ফান্ড, চিকিৎসার জন্য মেডিকেল সেন্টার এবং হেল্থ ও লাইফ ইনস্যুরেন্সের ব্যবস্থা আছে। কাছেই আকিজের আরও একটি প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। পাইপ , পার্টিকেল বোর্ড উৎপাদনসহ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।'
আমিড়াবাড়ি এলাকায় দবিরউদ্দিন স্পিনিং মিল লিমিটেডের কারখানায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। কারখানাটিতে প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক কর্মরত। তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশই স্থানীয় এবং নারী কর্মীদের সংখ্যা বেশি।
দবিরউদ্দিন স্পিনিং মিল লিমিটেডের এইচআর অ্যাডমিনের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মো. সেলিম আল রেজা বলেন, 'প্রতিদিন আমরা ১২০ টন সুতা তৈরি করছি, যা বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানায় কাপড় তৈরির কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'শ্রমিক হিসেবে তাদের জন্য নিয়ম অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। দূর থেকে যারা আসেন, তাদের জন্য কোম্পানির পক্ষ থকে ফ্রি বাস সার্ভিস চালু রয়েছে। শি আমি খেয়াল করেছি ল্পায়নের ফলে গ্রামের কর্মীদের মধ্যে জীবনযাত্রায় আচরণগত পরিবর্তনও আসছে।'
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ময়মনসিংহের উপমহাপরিদর্শক মো. বুলবুল আহমেদ বলেন, 'ত্রিশালে ৫-৬টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। এর মধ্যে আকিজ, ভূঁইয়া পেপার মিল, দবিরউদ্দিন স্পিনিং মিল, মিনিস্টার, রোজ গার্মেন্টস প্রভৃতি রয়েছে। আরও শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এখানে কর্মসংস্থানের কারণে এক ধরনের সাপ্লাই চেইন তৈরি হচ্ছে। যেমন কেউ শ্রমিকদের বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে, কেও পরিবহন ব্যবসায় নেমেছে, খাবারের হোটেল বাড়ছে ইত্যাদি।'
তিনি আরও বলেন, 'আমরা শ্রমিকদের স্বার্থ দেখছি। গত এক বছরে ৫৪টি অভিযোগ আমরা নিষ্পত্তি করেছি। কারখানা শ্রমিকদের সচেতন রাখতে মাইকিং, উদ্বুদ্ধকরণ সভা ও সরেজমিনে ফ্যাক্টরিতে যাচ্ছি।'
আত্মকর্মসংস্থান
বড় কারখানাগুলো চাকরির সুযোগ তৈরি ছাড়াও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
আমিরাবাড়ি ইউনিয়নে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশেই ড্রেসডেন টেক্সটাইলস লিমিটেড। কারখানার গেটের সামনেই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমিনুল হকের দোকান।
তিনি জানালেন, কারখানা হওয়ার পর মানুষের চলাচল বেড়ে যাওয়ার ফ্যাক্টরি গেটকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ছোটখাটো বাজার। এখানে বেশ কিছু দোকানঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়েছেন জমির মালিক।
আমিনুল বলেন, 'প্রায় ৪ লাখ টাকা লগ্নি করে মনিহারির দোকান দিয়েছি। একজন কর্মচারীও রেখেছি। এখন এই দোকানের বেচাবিক্রি থেকে চলছে আমার সংসার।'
সুযোগের পিছু পিছু এসেছে সমস্যাও
সরেজমিনে দেখা গেছে শিল্পায়নের ফলে গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি নানা ধরনের সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ নিয়ে ভাবনায় পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়ন আন্দোলনের ময়মনসিংহের সাধারণ সম্পাদক শিব্বির আহমেদ লিটন বলেন, 'শিল্পের ছোঁয়া লাগছে, তা অবশ্যই ভালো একটি দিক। তবে অতীতে দেখা গেছে যেসব এলাকায় শিল্পায়ন হয়েছে সেখানে পরিবেশের চরম ক্ষতি হয়েছে। ত্রিশালেও এর ব্যতিক্রম নয়। ইতোমধ্যে বানার নদটি চরম দূষণের মুখে পড়েছে। আমরা পরিকল্পিত শিল্পায়ন চাই। গ্রামের নদী-নালা, খাল-বিল পুকুর-ডোবা, গাছপালা, বনবিথী, খেতখামার যথাযথভাবে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রণয়ন করতে হবে সব পরিকল্পনা। এর জন্য শুরু থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।'
এদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের আগে জমি সংগ্রেহের সময় ঘটছে অপরাধ। যা স্থানীয় লোকজনের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, কোম্পানিগুলো কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি জমি না কিনে দ্বারস্থ হচ্ছে দালালদের। ফলে গড়ে উঠছে দালালচক্র। তারা পেশিশক্তির জোরে ঠকাচ্ছে কৃষকদের। কম মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে জমি নিয়ে বেশি দামে বিক্রি করছে কোম্পানির কাছে। জমি বিক্রি করতে রাজি না হলে করা হচ্ছে জোরজবরদস্তি। ঘটছে হত্যার মতো ঘটনাও।
২০১৬ সালে জমি অধিগ্রহণ-সংক্রান্ত বিবাদে খুন হন ত্রিশালের খাগাটিপাড়ার মুক্তিযোদ্ধা মতিন মাস্টার। এই হত্যামামলার অভিযোগপত্রে পুলিশ উল্লেখ করে জালিয়াতি করে কৃষকদের জমি দখলের চক্রের কথা। একই এলাকায় ২০১৯ সালের ৫ এপ্রিল একই কারণে খুন হন রফিকুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তি। এখানেও পুলিশ অভিযোগপত্রে স্থানীয় দালালচক্রের কথা নিশ্চিত করে। এরপর জামতলি গ্রামে এ বছরের ১৪ এপ্রিল জমি দখলকারীদের হাত থেকে ভাতিজাকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন আবুল কালাম আজাদ নামে এক ব্যক্তি।
এছাড়াও কোম্পানির কাচ্ছে জমি বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে হামলা, মামলা, হুমকি, মারধরের ঘটনা ঘটছে। যা গ্রামের মানুষের অশান্তি ও ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ত্রিশাল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাইন উদ্দিন বলেন, 'ফ্যাক্টরির সাথে জমি কেনাবেচা-সংক্রান্ত যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সবগুলোতে অপরাধীদের চিহ্নিত করে কোর্টে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে অপরাধীদের। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেজন্য পুলিশ তৎপর আছে।'