পোশাক খাতে মজুরি বৃদ্ধির চাপ বাড়ছে, কতটুকু প্রস্তুত মালিকপক্ষ?
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির জন্য তৈরি শ্রম আইন অনুযায়ী, পাঁচ বছরের মধ্যে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কথা থাকলেও নির্ধারিত সময়ের আগেই এ দাবিকে সামনে রেখে শ্রমিকদের আন্দোলন জোরালো হচ্ছে। একই দাবিতে রাজধানীর মিরপুরের বেশকিছু কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ এমনকি ভাংচুরও চালিয়েছে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, দেশের অন্যান্য শিল্প অধ্যুষিত এলাকায়ও একই দাবিতে শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে পারেন।
কিন্তু কেন হঠাৎ করেই এ আন্দোলন? কারখানা মালিক ও শ্রমিক নেতাদের একটি অংশ এর পেছনে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র দেখছেন।
তবে শ্রমিকরা বলছেন, সর্বশেষ মজুরি বৃদ্ধির পর গত সাড়ে তিন বছরে যে হারে পণ্যমূল্য বেড়েছে, তার সাথে শ্রমিকরা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাড়তি সময় কাজ করেও (ওভারটাইম ডিউটি) তারা পণ্যের মূল্যের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছেন না । এজন্য পাঁচ বছরের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই শ্রমিকদের মজুরি রিভিউ করতে নতুন মজুরি বোর্ড গঠন করা দরকার।
ইতোমধ্যে দেশের অন্যতম প্রভাবশালী শ্রমিক ফেডারেশনগুলোর প্ল্যাটফর্ম ইন্ডাস্ট্রি অল বাংলাদেশ কাউন্সিল সরকারের কাছে পোশাক খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে দুই দফা চিঠি দিয়েছে। কাউন্সিলে প্রায় ১৮টি শ্রমিক ফেডারেশন অনুমোদিত।
গত মার্চের শেষদিকে পাঠানো সর্বশেষ চিঠিতে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার বিদ্যমান পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। চিঠিতে আরও বলা হয়, যেকোনো সময় শ্রম অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করতে পারে।
সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর হিসাব অনুযায়ী, এ খাতের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির পর ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। যদিও শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, এই হার আরো অনেক বেশি।
তবে নতুন করে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির এ আলোচনায় রীতিমত ভীত হয়ে পড়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
বর্তমানে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মাসে ৮ হাজার টাকা।
স্প্যারো গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর শোভন ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ইনফ্লেশন হয়েছে, সত্য। কিন্তু শ্রমিকদের বেতনও বেড়েছে।"
তার কারখানায় প্রায় ১৪ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। বছরে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের অ্যাপারেল পন্য রপ্তানি করেন তিনি।
শোভন ইসলাম আরও বলেন, "অতীতে আমরা নতুন মজুরি বাস্তবায়নের বিরোধিতা করেছি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আমাদের মূল রপ্তানির বাজারগুলোতে নতুন করে মন্দা দেখা দিচ্ছে। উৎপাদন খরচ অনুযায়ী পণ্যের দাম বাড়ছে না। আগামী মাসগুলোতে ইতোমধ্যে অর্ডার কমতির দিকে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন মজুরি বৃদ্ধির চাপ আমরা নিতে পারবো না। এটা হবে আত্মঘাতী।"
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহৎ ব্র্যান্ড ওয়ালমার্টের সিইওর একটি আলোচনার সূত্র উল্লেখ করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে এখন ৬.৫ বিলিয়ন পিস পোশাকের ইনভেন্টরি রয়েছে।
শ্রমিকরা সরকারের ঘোষিত মজুরির চেয়ে বেশি পাচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, "আমার কারখানায় একজন হেল্পার মাসে গড়ে ১২ হাজার টাকা করে বেতন পান। আর অপারেটররা পান ১৬ হাজার টাকার মতো।
নারায়ণগঞ্জভিত্তিক নিটওয়্যার কারখানা ফতুল্লা অ্যাপারেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলি শামীম এশান টিবিএসকে বলেন, "দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর দাবি যৌক্তিক। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পুরো পরিস্থিতি ওলটপালট করে দিয়েছে। অর্ডারের ফ্লো কমে গেছে। আমরা তো তাদের কাছে বাড়তি দামও চাইতে পারবো না।"
"স্বল্প আয়ের পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে সাপোর্ট দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। তাদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহ করা দরকার। কিন্তু এই চাপ তো কারখানা মালিকরা নিতে পারবে না," বলেন তিনি।
শ্রমিক নেতাদের বক্তব্য
ছোট ইস্যু দিয়ে শনিবার অসন্তোষ শুরু হওয়ার পর গতকাল দ্বিতীয় দিন রবিবার মিরপুরে সড়ক অবরোধের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর দাবিতেই মূলত কথা বলেছে।
স্নোটেক্স গার্মেন্টসের কর্মী মো. সবুজ গণমাধ্যমকে জানান, ২০১৯ সাল থেকে তারা যে বেতন পাচ্ছেন গত তিন বছরে এক পয়সাও বাড়ানো হয়নি।
"আমরা ২০১৯ সাল থেকে একই বেতন পাচ্ছি কিন্তু গৃহস্থালির খরচ এবং পণ্যের দাম এই সময়ের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমরা কিভাবে শহরে এই পরিস্থিতিতে থাকব যেখানে ভোজ্যতেল এবং অন্যান্য দৈনন্দিন পণ্যের দাম মেটাতেই আমাদের আয়ের বেশিরভাগ অংশ খরচ হয়ে যায়। এর উপর রয়েছে বাসা ভাড়ার চাপ," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ সম্মিলিত পোশাক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার টিবিএসকে বলেন, "পণ্যমূল্য গত তিন বছরে কী পরিমাণ বেড়েছে, আপনারা সবাই জানেন। শ্রমিকরা ১৪ ঘণ্টা কাজ করেও সংসার চালাতে পারছে না। বেতন বাড়ানো দরকার।"
শ্রম আইন কী বলে?
বাংলাদেশে বিদ্যমান ২০০৬ সালের শ্রম আইনে, (২০১৮ সালে সংশোধিত) প্রতি পাঁচ বছর পর পর শ্রমিকদের মজুরি পর্যালোচনার কথা বলা আছে।
পোশাক খাতের শ্রমিকদের সর্বশেষ মিনিমাম ওয়েজ বোর্ড গঠন করা হয় ২০১৮ সালে আর বাস্তবায়ন শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে। সেই হিসেবে পাঁচ বছর এখনো হয়নি।
তবে ২০১৩ সালে আইনের সংশোধনীর ১৪০ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার চাইলে পাঁচ বছরের আগেও এটি রিভিউ করতে পারবে।
এর উদাহরণও অতীতে রয়েছে। ২০১০ সালের পর তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়।
বাংলাদেশে আরএমজি খাতে প্রথম ন্যূনতম মজুরি গঠন হয় ১৯৮৪ সালে। সেসময় ন্যূনতম মজুরি ছিল ৫৬০ টাকা। এ পর্যন্ত মোট ৬ বার এ খাতের শ্রমিকদের মজুরি সংশোধন করা হয়েছে। সর্বশেষ ন্যূনতম মজুরি হয়েছে ৮ হাজার টাকা।
পোশাক খাতের মজুরিতে বাংলাদেশ এখনো সবার নিচে?
স্ট্যাটিস্টিয়া'র ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, সাতটি দেশের মধ্যে মজুরিতে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নিচে, যা ছিলো ৯৫ ডলার। বাংলাদেশের উপরে ছিলো যথাক্রমে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ভারত, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।