ব্যয়-বিলাসে আটকে আছে ভারী যানবাহনের চালক তৈরির প্রকল্প
নিবন্ধিত ২ লাখ ৫০ হাজার ৮০৩টি ভারী যানবাহনের বিপরীতে দেশে এ শ্রেণীর লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা এক লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৩। সরল হিসাবে ভারী চালকের ঘাটতি ৬৭,০৩০ মনে হলেও প্রতি যানবাহনে ১.৫-২ চালকের প্রয়োজন হওয়ায় চাহিদা মেটাতে আরও অন্তত তিন লাখ চালক প্রয়োজন।
হালকা ও মাঝারী শ্রেণীর পেশাদার লাইসেন্সধারী চালকদের দুই থেকে চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে নতুন তিন লাখ ভারী ড্রাইভার তৈরি করে এ চাহিদা মেটাতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশন (বিআরটিসি) ২০১৯ সালে একটি প্রকল্প তৈরি করলেও বিভিন্ন খাতে বাড়তি ব্যয়ের কারণে অনুমোদন দিচ্ছে না পরিকল্পনা কমিশন।
সূত্র জানায়, ৭৬৮.৬৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রায় আড়াই বছর পর আবারো 'ভারী যানবাহন চালক তৈরীর লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ প্রদান' প্রকল্পের প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এ প্রকল্পের আওতায় তিন লাখ চালককে প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে মাথাপিছু ব্যয় হবে ২৫.৬২ হাজার টাকা।
আগামী সপ্তাহে এই প্রস্তাবের ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভার আয়োজন করতে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগ। এ সভায় চালক তৈরিতে বিদেশ সফর, ১১৭.৫৮ কোটি টাকার ভবন নির্মাণ, পরামর্শক খাতে ৫০ লাখ টাকা ছাড়াও বিভিন্ন খাতে ব্যয় প্রস্তাবের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরাপদ সড়ক পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারী যানবাহন চালকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সঠিক লাইসেন্সিংয়ের আওতায় আনার লক্ষ্যে ২০১৯ সালে ৯৭৭.৬০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এ প্রকল্প অনুমোদন পেলে প্রতি বছর অন্তত ৬০ হাজার চালক তৈরি করা যেত।
তবে পরিকল্পনা কমিশনে অনুষ্ঠিত পিইসি সভায় চালকপ্রতি ৩২.৫৯ হাজার টাকার প্রশিক্ষণ ব্যয়কে অযৌক্তিক হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যয় যৌক্তিককরণ কমিটি গঠন করে প্রকল্পটি ফেরত পাঠানো হয়।
বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে ৫৭৮.৯০ কোটি টাকায় প্রকল্পের ব্যয় নামিয়ে আনার সুপারিশ করে। এটা করা গেলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ৩৯৮.৭৩ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারত।
তবে কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ ৭৬৮.৬৬ কোটি টাকা ব্যয় ধরে প্রকল্পটি পুনর্গঠন করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে। এ হিসাবে কমিটির সুপারিশের চাইতে ১৮৯.৭৬ কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় হচ্ছে।
আগামী সপ্তাহে অনুষ্ঠিতব্য পিইসি সভার কার্য্যপত্রে বলা হয়েছে, কমিটির সুপারিশের বাইরে অতিরিক্ত ১৮৯.৭৬ কোটি টাকা প্রস্তাবের ব্যাখ্যা জানতে চাইবে পরিকল্পনা কমিশন।
এতে আরও বলা হয়েছে, প্রশিক্ষণ পরিচালনায় ৩৩ সিমুলেটর কেনায় ৩৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছিল যাচাই কমিটি। এর বিপরীতে ৫০ কোটি টাকায় ১০০ সিমুলেটর কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাড়তি সিমুলেটর কেনার যৌক্তিকতা জানতে চাইবে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পটি ২০ বছর বা এর বেশি বয়সী পেশাদার চালক যারা চালনা পেশায় নিয়োজিত, তাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় দেশের সব জেলায় বিআরটিসির সকল প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ও কেন্দ্র, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের সকল কেন্দ্র, বিআরটিএ অনুমোদিত ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুল, যে সব জেলায় বিআরটিসি ও এএফডির কোন ট্রেনিং সেন্টার নেই সে সব জেলায় রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং জামালপুরের বাংলাদেশ পুলিশ মোটর ড্রাইভিং ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
প্রশিক্ষণ পরিচালনায় ব্যয় যৌক্তিককরণ কমিটি ২৫ ছাত্রাবাসের জন্য ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ের সুপারিশ করলেও ১৫ ভবন ও স্থাপনা নির্মাণে চাওয়া হয়েছে ১১৭.৫৮ কোটি টাকা। কনসালটেন্সি বাবদ ৫০ লাখ টাকা নতুন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা আগের ডিপিপিতে ছিল না।
বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ৫০ লাখ ব্যয়ের প্রস্তাব নিয়েও আপত্তি রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের। যানবাহন ভাড়া বাবদ ৪.৩৮ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রয়োজনীয়তা ও ব্যয় প্রাক্কলনের ভিত্তিও জানতে চাইবে কমিশন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, সাস্টেইনেবল ডেভলপমেন্ট গোল (এসডিজি) পূরণে ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ৫০% হ্রাস করার কথা রয়েছে।
প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ভারি যানবাহনের ড্রাইভার তৈরী হবে। এর ফলে সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
তাছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে সৃষ্ট দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাড়ীচালকদের বিদেশে পাঠিয়ে বৈদেশিক রেমিটেন্স অর্জন সরকারের জন্য একটি সম্ভাব্য লাভজনক খাত হিসেবে পরিগণিত হতে পারে।
বিআরটিসি সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় হালকা যানবাহনের চালকদের মধ্যে যাদের লাইসেন্স এর ঘাটতি রয়েছে তাদের ড্রাইভিং কম্পিটেন্সি টেস্ট বোর্ড-এর মাধ্যমে যাচাই করে ভারী লাইসেন্স প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। ড্রাইভারদের উন্নত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করে তোলা হবে।