স্থায়ী চাকরির দাবিতে প্রাইম মুভার অপারেটরদের ধর্মঘটে বিপাকে মেঘনা গ্রুপ
পরিবহণ শ্রমিকদের স্থায়ী নিয়োগের দাবিতে মেঘনা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই) পণ্য পরিবহনে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে প্রতিষ্ঠানটির প্রাইমমুভার চালক ও হেল্পারদের বিরুদ্ধে। এতে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলে অভিযোগ জানিয়েছেন মেঘনা গ্রুপের কর্মকর্তারা।
স্থায়ী নিয়োগপত্রসহ নয় দফা দাবিতে গত ২৯ জুন থেকে ধর্মঘট শুরু করে মেঘনা গ্রুপের প্রাইম মুভার চালক ও হেল্পাররা।
মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মিজানুর রহমান টিবিএসকে বলেন, গত ২৯ জুন থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ১৩ দিনে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অন্তত ১০০ কনটেইনার পণ্য ডেলিভারি নেওয়া সম্ভব হয়নি। সময়মতো পণ্য খালাস করতে না পারায় পারায় বন্দর কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত ফি দিতে হচ্ছে মেঘনা গ্রুপকে। শিপিং ও অন্যান্য খরচ বাবদ ক্ষতির পরিমাণ ১ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, ধর্মঘটের কারণে আমদানি করা প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বন্দর থেকে সারা বাংলাদেশের কারখানায় পরিবহণ করা যাচ্ছে না।
প্রাইম মুভার হলো ভারী-শুল্ক বাহন বা ট্রাক যেটি সাধারণত পণ্য বা কাঁচামাল পরিবহণ করতে এবং লোডিং, আনলোডিং ও কার্গো সরানোর জন্য ব্যবহৃত হয়।
মেঘনা গ্রুপের প্রাইম মুভার চালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমি ১২ বছর ধরে এই কোম্পানির গাড়ি চালালেও এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি আমাদের কোন নিয়োগপত্র দেয়নি।'
তিনি বলেন, 'স্থায়ী নিয়োগপত্র সহ বিভিন্ন দাবিতে আমরা আন্দোলনে করছি এবং ধর্মঘটে আছি। শ্রম অধিদপ্তরের মধ্যস্থতায় বৈঠক হলেও মেঘনা গ্রুপ আমাদের স্থায়ী নিয়োগপত্র দিতে রাজী নয়।'
চট্টগ্রাম জেলা প্রাইমমুভার ট্রেইলার, কনক্রিট মিক্সার, ফ্ল্যাটবেড ও ড্রামট্রাক শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রমিক ইউনিয়ন মেঘনা গ্রুপকে যানবাহন ভাড়া দেওয়া বন্ধ করার আহ্বান জানানোর পর থেকেই ধর্মঘট শুরু হয়।
চট্টগ্রাম জেলা প্রাইমমুভার ট্রেইলার, কনক্রিট মিক্সার, ফ্ল্যাটবেড ও ড্রামট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আবুল খায়ের বলেন, অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানে চালক হেল্পারদের নিয়োগ পত্র দেওয়া হলেও মেঘনা গ্রুপ নিয়োগ পত্র দেয়নি। এর ফলে শ্রমিকরা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে না।
মেঘনা গ্রুপের পণ্য পরিবহনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে গাড়ি সরবরাহ না করতে চিঠি দেওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুরুতে সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ধরনের চিঠি দিলেও পরবর্তীতে তা প্রত্যাহার করা হয়েছে।
চলমান সংকট মোকাবিলায় এমজিআই শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করলেও কোনো সমাধান হয়নি বলে জানিয়েছেন মেঘনা গ্রুপের সিনিয়র ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, এমজিআই অচলাবস্থা নিরসনে এবং কয়েকদিন ধরে বন্দরে আটকে থাকা চিনি ও ভোজ্যতেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহণ সচল করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং শ্রম বিভাগের কাছে সহায়তা চেয়েছে।
মিজানুর বলেন, 'অত্যাবশ্যকীয় আমদানিকৃত কাঁচামাল যেমন চিনি, ভোজ্য তেল এবং রাসায়নিক বন্দর থেকে মেঘনা গ্রুপের কারখানায় দ্রুত পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।'
মেঘনা গ্রুপের তথ্য অনুযায়ী, নিজস্ব ৫৫টি ট্রেইলার বা প্রাইম মুভার দিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের কারখানাগুলোতে পরিবহণ করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি।
এসব প্রাইম মুভার চালানোর জন্য রয়েছে ১২০ জনের মত চালক ও হেল্পার। স্থায়ী চাকরিসহ নয় দফা দাবিতে ২৯ জুন থেকে ধর্মঘট শুরু করে তারা।
এতে গ্রুপটির গত ১৩ দিনে অন্তত ১০০ কনটেইনার আমদানি পণ্য আটকে পড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা।
প্রথম কয়েকদিন বিভিন্ন পরিবহণ সংস্থা থেকে প্রাইম মুভার ভাড়ায় নিয়ে পণ্য পরিবহণ কোনোমতে সচল রাখে মেঘনা গ্রুপ। কিন্তু গত ২ জুলাই চট্টগ্রাম জেলা প্রাইমমুভার ট্রেইলার, কনক্রিট মিক্সার, ফ্ল্যাটবেড ও ড্রামট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন নামের একটি সংগঠন বিভিন্ন পরিবহণ সংস্থাকে চিঠি দিয়ে মেঘনা গ্রুপকে ট্রেইলার ভাড়া দিতে নিষেধ করার পর একেবারে বন্ধ হয়ে যায় পণ্য পরিবহণ।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য অনুযায়ী, আমদানিকৃত পণ্যের কনটেইনার ৪ দিন বন্দরের ইয়ার্ডে বিনা ভাড়ায় রাখার সুযোগ পান আমদানিকারকরা। তারপর ২০ ফুট লম্বা একটি কন্টেইনারের জন্য প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন ৬ মার্কিন ডলার ভাড়া গুনতে হয়। তার পরবর্তী সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন একই সাইজের কন্টেইনারে ১২ ডলার এবং ২১ দিন থেকে প্রতিদিন ২৪ ডলার হিসাবে ভাড়া দিতে হয় আমদানিকারকদের।
মিজানুর রহমান বলেন, পরিবহণ শ্রমিকরা যে নয় দফা দাবি দিয়েছিল তার আটটি মেনে নেয়া হয়েছে। শ্রম আইন মোতাবেক শ্রমিকদের ছয় মাসের প্রবেশন পিরিয়ড দিয়ে নিয়োগ পত্র দেয়ার বিষয়েও সম্মত হয়েছে প্রতিষ্ঠান। তবে, শ্রমিকদের দাবি তাদের স্থায়ী নিয়োগপত্র দিতে হবে।
তিনি আরো বলেন, এ বিষয়ে ১০ জুলাই শ্রম অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয়। তবে, পরিচালকের অসহযোগিতায় বৈঠকটি সফল হয় নি।
এ বিষয়ে শ্রম অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক শফিকুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'মেঘনা গ্রুপের শ্রমিকদের দাবি দাওয়া নিয়ে গত ৮ ও ১০ জুলাই দুই দফা বৈঠক হয়েছে। শ্রমিকরা স্থায়ী নিয়োগপত্রের দাবি জানালেও মেঘনা গ্রুপ সাময়িক নিয়োগপত্র দিতে সম্মত হয়। তবে শ্রমিকরা তা মেনে নেয়নি।'
তিনি আরো বলেন, 'তারপরও আমরা শ্রমিকদের কাজে ফিরে যেতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তবে তারা সেটি মেনে নেয় নি।'
শ্রমিক ও মেঘনা গ্রুপের মালিক পক্ষ পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সহসাই সমস্যার সমাধান করতে না পারলে পণ্য পরিবহনের এই সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে বলে মনে করছেন শ্রম অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাই উভয় পক্ষকে কিছুটা ছাড় দিয়ে সমঝোতায় আসার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।