শিপিং লাইনগুলো বাংলাদেশ থেকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড পরিবহন করতে চাইছে না
সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের রপ্তানি চালান জাহাজীকরণের জন্য চট্টগ্রামের ওসিএল কন্টেইনার ডিপোতে নিয়ে আসে। তবে গত ৪ জুন সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার জেরে সামুদা কেমিক্যালের এ রপ্তানি চালান আটকে যায়।
ডিপো কর্তৃপক্ষ ইমেইলের মাধ্যমে সামুদা কেমিক্যাল কর্তৃপক্ষকে গত বুধবার (৮ জুন) হাইড্রোজের পার অক্সাইডের চালান কারখানায় ফেরত নিতে বলে। ফলে রপ্তানি না করেই হাইড্রোজেন পার অক্সাইডগুলো কারখানায় ফেরত আনতে হচ্ছে তাদের।
প্রতি মাসে সামুদা কেমিক্যাল প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করে। প্রতি টনের মূল্য সর্বোচ্চ ৫০০ ইউএস ডলার পর্যন্ত। সে হিসেবে সামুদা কেমিক্যালের প্রতি মাসে ২০ লাখ বা ২ মিলিয়ন ইউএস ডলারের রপ্তানি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
শুধু সামুদা কেমিক্যালই নয়, দেশের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, এসএম কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড, ইনফেনিয়া কেমিক্যাল কোম্পানির অবস্থাও একই। সরকারের ১০ শতাংশ আর্থিক সহায়তা প্রাপ্ত এই পণ্যটির রপ্তানির সাথে জড়িত বিএম কন্টেইনার ডিপো মালিকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সও।
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) সূত্র জানিয়েছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর চারটি ডিপোতে ১১১ কন্টেইনার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড আটকা পড়ে। চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হওয়ার কথা ছিলো এসব পণ্য। চট্টগ্রামের ওসিএল ডিপোতে ৪৯ কন্টেইনার, পোর্টলিংক ডিপোতে ৩১ কন্টেনার, ইস্টার্ন লজিস্টিকে ২৪ কন্টেইনার এবং কেএনটিতে ৭ কন্টেনার হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রয়েছে।
২০ ফুট সাইজের একটি কন্টেইনারে ২০ টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বোঝাই করে জাহাজীকরণ করা হয়। প্রতি টন ৫০০ ইউএস ডলার হিসেবে এক টিইইউস কন্টেইনারে ১০ হাজার ইউএস ডলারের পণ্য থাকে। গার্মেন্টস শিল্পের ওয়াশিং প্ল্যান্টসহ নানা খাতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ব্যবহৃত হয়।
এদিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে বিস্ফোরণের ঘটনায় এই পণ্যের রপ্তানি বাণিজ্যে বিশ্বাস হারানোর উপক্রম হয়েছে; বাংলাদেশ থেকে এই পণ্য পরিবহনে ইতোমধ্যে শিপিং লাইনগুলো অনাগ্রহ প্রকাশ করছে।
এই খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি খাত চরম সংকটে পড়েছে। রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেলে এই খাতের ব্যবসায়ীরা যেমন ক্ষতির সম্মুখীন হবেন, তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে পড়বে নেতিবাচক প্রভাব। রপ্তানি বাণিজ্যে এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী হবে। অন্যদিকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রক্ষণাবেক্ষণ, পরিবহনসহ ডিপোগুলোতে সেইফটি সিকিউরিটির বিষয়েও আমদানিকারকেরা প্রশ্ন তুলেছেন।
সামুদা কেমিক্যালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মামুনুল ইসলাম বলেন, 'গত ১৫ বছর ধরে সামুদা কেমিক্যাল হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করছে। প্রতিবছর বাড়ছিলো রপ্তানির পরিমাণ। বিএম কন্টেইনার ডিপোর দুর্ঘটনার ফলে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি খাতে খুবই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতোমধ্যে এই প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।'
এদিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থেকে বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বাংলাদেশ থেকে এই পণ্য পরিবহনে অনীহা প্রকাশ করছে মেইন লাইন অপারেটরগুলো। ওএনই, ওওসিএল, গোল্ডস্টারসহ বিভিন্ন শিপিং লাইন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভর্তি কোনো কন্টেইনার পরিবহন করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্টস এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ এসব তথ্য জানিয়েছেন।
অন্যদিকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুর কার্গো ইয়ার্ড কর্তৃপক্ষ। নিরাপত্তা ও ইয়ার্ডের ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাওয়ায় হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান সীমিত করার নির্দেশনা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এমন নির্দেশনার পর বাংলাদেশের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানির পথ আরো কঠিন হয়ে উঠেছে। বাংলদেশ থেকে যে রপ্তানি পণ্য পরিবহন করা হয় সেগুলো ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর যেমন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন বন্দর হয়ে যায়।
ইস্টার্ন লজিস্টিকসের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার এডমিন খন্দকার মাসুদ রানা বলেন, 'আমাদের ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের যেসব রপ্তানি চালান রয়েছে সেগুলোর বিষয়ে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর আলোচনা চলছে। আজ রোববার এ বিষয়ে কাস্টম হাউসে সকল ডিপো কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক রয়েছে। ওই বৈঠকের পর পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানা যাবে।'
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের প্রায় ৮টি কারখানায় উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বাংলাদেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহারের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, চীন, কোরিয়া, পাকিস্তান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও দক্ষিণ আফ্রিকা সহ ১৪টি দেশে রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ২ কোটি ৩৩ লাখ ডলারের হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি হয়। চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে তার আগের অর্থবছরের পুরো সময়ের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি রপ্তানি হয়।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জুন থেকে ২০২২ সালের ৩১ মে পর্যন্ত ১১টি প্রতিষ্ঠান এক লাখ ৩০ হাজার ৩৯৩ মেট্রিক টন হাইড্রোজেন পার অক্সাইড রপ্তানি করে। যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ছিল ৪০৪ কোটি ৩১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৫ টাকা।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের পর বিষয়টি নিয়ে এক ধরণের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাময়িকভাবে মেইন লাইন অপারেটরের বিভিন্ন জাহাজের ক্যাপ্টেন, পোর্ট কর্তৃপক্ষ পণ্যটি বহন করতে চাচ্ছেন না। আশা করি দ্রুত বিষয়টির সমাধান হবে।'
তৈরী পোশাক সহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের মতো জাহাজীকরণের আগে ১৯টি বেসরকারি আইসিডিতে পাঠানো হয় হাইড্রোজেন পার অক্সাইড। আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল রুহুল আমিন শিকদার বলেন, 'বিভিন্ন ডিপোতে রপ্তানির উদ্দেশ্যে আসা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের চালান গ্রহণ না করায় এই খাতের রপ্তানি সংকটে পড়বে।'