বড় পরিকল্পনা রেলওয়ের। সেবার মানও কি বাড়বে?
সরকারি নথির তথ্যানুসারে, রেল পরিষেবার আওতা বাড়ানো, আপগ্রেড ও ইউনিফিকেশনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ে আগামী তিন বছরে প্রায় ৫৬০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে।
চলতি বছরের মার্চে ২০০টি ব্রডগেজ কোচ সংগ্রহের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে সরকোর। আরও ১০০টি ব্রডগেজ কোচ কেনা হচ্ছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায়। এছাড়া রেলওয়ে সম্প্রতি ২৬০টি ব্রডগেজ কোচ কেনার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছে।
বর্তমানে রেলওয়েতে ব্রডগেজ কোচ রয়েছে ৪৬৮টি এবং ১,২১৭টি মিটারগেজ প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ রয়েছে। আর দেশের মোট রেলপথের দৈর্ঘ্য ৩,০৯৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে মিটারগেজ রেলপথই বেশি। কিন্তু ছোট ছোট বগি এবং ব্রডগেজ ক্যারেজের তুলনায় কম যাত্রী বহন করে বলে মিটারগেজ ট্রেন এখন সেকেলে হয়ে গেছে।
যে রেলরাস্তা এক মিটার প্রশস্ত, তা-ই মিটারগেজ। এই রেলপথে ট্রেনের গতি সামান্য বাড়ালেও কোচগুলো প্রবলভাবে দুলতে থাকে। অন্যদিকে ব্রডগেজ রেলে—যা কিনা বড় ট্রেন নামেও পরিচিত—ভ্রমণ তুলনামূলক আরামদায়ক ও দ্রুত। এছাড়া ব্রডগেজ ট্রেনে যাত্রী সংকুলানও বেশি হয়।
ভারত ও পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো প্রায় সমস্ত সেকেলে মিটারগেজ ট্রেন পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দিয়েছে। বাংলাদেশেও চলমান বড় রেল-সংক্রান্ত প্রকল্পগুলোতেও মিটারগেজ ট্রেনকে বিবেচনায় রাখা হয়নি। ফলে পুরোনো ট্র্যাক প্রতিস্থাপন করে নতুন ট্র্যাক বসানোর জন্য কর্তৃপক্ষের উপর চাপ বাড়ছে।
রেলওয়ের একটি মাস্টারপ্ল্যানে আগামী ২০ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে দেশের সমস্ত মিটারগেজ ট্র্যাককে পর্যায়ক্রমে ব্রডগেজ ও ডুয়েলগেজে রূপান্তরিত করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার জানিয়েছেন, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়েতে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প, যমুনা নদীর ওপর রেল সেতু, খুলনা-মোংলা রেললাইন, জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে নতুন ট্রেন চালু করা হবে। এতে ব্রডগেজ কোচের চাহিদা বহুগুণে বাড়বে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন রেলওয়ে আঞ্চলিক রেল সংযোগের জন্য মিটারগেজ লাইনকে ব্রডগেজে বা ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ শুরু করেছে রেলওয়ে।
রেলওয়ের তথ্যানুসারে, এখন শুধু রেলের পশ্চিমাঞ্চলে ব্রডগেজ ও ডুয়েলগেজ লাইন রয়েছে, আর পূর্বাঞ্চলে কেবল মিটারগেজ লাইন রয়েছে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে ৯২টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ সেবা দিচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বহরে আরও ৪৬টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ যুক্ত করা হবে। এখন প্রায় ২,৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চলছে।
নভেম্বরে চীন থেকে আসছে ৩২টি ক্যারেজ
পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ১০০টি প্যাসেঞ্জার ক্যারেজ কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩২টি ক্যারেজ আগামী নভেম্বরে চীন থেকে বাংলাদেশে আসছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
বাকি ক্যারেজগুলো ধাপে ধাপে আসবে।
এছাড়া গত মার্চে ২০০টি ব্রডগেজ কোচ সংগ্রহের একটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (ইআইবি) ও সরকার যৌথভাবে ১,০৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটির অর্থায়ন করছে। প্রকল্পটি ২০২৫ সাল নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করছে রেলওয়ে।
রেলওয়ের ২৬০টি কোচ কেনার প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের নীতিগত অনুমোদন এবং বৈদেশিক ঋণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠানো হয়েছে।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করার পর রেলওয়ে প্রাক্কলন করেছে, ২৬০টি কোচ কিনতে ব্যয় হবে ২,২৩৭ কোটি টাকা।
বৈদেশিক ঋণ নিশ্চিত হলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে বলে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে রেলওয়েতে ব্রডগেজ কোচ রয়েছে ৪৬৮টি, যার মধ্যে ১৯০টি (৪১ শতাংশ) কোচের আয়ুষ্কাল ইতিমধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে। একটি কোচের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ধরা হয় ৩৫ বছর।
রেলওয়ের মাস্টারপ্ল্যানে (২০১৬-২০৪৫) মোট ছয় ধাপে সর্বমোট ৪,২১১টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে।
ডাবলগেজ ট্রেনের সংখ্যা বাড়ালেই কি বাড়বে সেবার মান?
প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান যেখানে দ্রুতগতি ও নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তাদের রেলওয়ে খাতে দ্রুত পরিবর্তন এনে একে তাদের পরিবহনের মেরুদণ্ডে পরিণত করেছে, বাংলাদেশ সেখানে উভয় দিক থেকেই পিছিয়ে রয়েছে। অথচ বাংলাদেশের অনেক অংশেও ১৭০ বছর আগে ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গেই রেল যোগাযোগ চালু হয়েছিল।
দেশের রেল পরিষেবা এবং উন্নয়নও অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রেলওয়ের প্রকল্পগুলো তাদের ট্রেনের মতোই কচ্ছপগতিতে চলছে। বাংলাদেশে রেল পরিষেবা ও ট্রেনের সময়সূচি নিয়েও ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কর্তৃপক্ষ যতক্ষণ অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তিকে গুরুত্ব না দেবে, ততক্ষণ পর্যন্ত রেল পরিষেবা উন্নত করা যাবে না।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক মো. সামছুল হক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'আধুনিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের দক্ষ ও প্রয়োজনীয় জনবল প্রয়োজন। সেইসঙ্গে অপারেশনাল কন্ডিশনের জন্য মান ধরে রাখা প্রয়োজন।'
তিনি বলেন, দেশের উন্নয়ন দর্শনে ক্রয়ের ওপরই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সিস্টেমের উন্নয়নে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
দক্ষ ব্যবস্থাপনা, সময়সূচি ঠিক রাখা এবং বছরজুড়ে রক্ষণাবেক্ষণের মতো বেশ কিছু বিষয়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এই সমস্যাগুলোর—যেগুলোর জন্য বিশাল বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে না—সমাধান হয় না। এটা আমাদের উন্নয়ন দর্শনের একটি বড় ত্রুটি।'
তবে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য মো. মামুন-আল-রশিদ জানিয়েছেন, রেলওয়ে ২৮ হাজার শূন্য পদে নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি জানান, গত মাসে অনুষ্ঠিত একনেকের সভায় রেলওয়ের জনবল ঘাটতি পূরণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে রেলওয়েকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া দক্ষতা উন্নয়নের জন্যও বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।