ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ডিপো মালিকের বিরুদ্ধে, ৬ কমিটির কেউ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার ১২ দিন পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি কোন সংস্থা।
৪৯ জনের প্রাণ হানি হলেও একটি মামলা করা ছাড়া দৃশ্যৎ কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বেসরকারি এই ডিপো পরিচালনায় পদে পদে অনিয়ম থাকলেও মালিক পক্ষের বিরুদ্ধে এখনো কোন ব্যবস্থা নেয়নি প্রশাসন। অথচ এ ঘটনার পর থেকে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড আমদানি-রপ্তানি অনেকটা বন্ধের পথে।
গত ৪ জুন রাতে বেসরকারি ডিপোটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪৯ জনের প্রাণ গেছে। এছাড়া আড়াই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে। আশপাশের এলাকার স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
নিয়ম না মেনে ডিপোতে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড রাখায় ভয়াবহতায় রূপ নেয় বলে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছে সংস্থাগুলো। এ রাসায়নিকের কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতেও অনেক বেগ পেতেও হয়েছে উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোকে।
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড জয়েন্ট ভেঞ্চারে বিএম কনটেইনার ডিপো পরিচালনা করে আসছে। বেসরকারি এই ডিপোটি পরিচালনার দায়িত্বে থাকা স্মার্ট গ্রুপের আরেকটি প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে হাইড্রোজেন পারঅক্সাইডও উৎপাদিত হয়েছে।
অনিয়মের আখড়া ছিল বিএম ডিপো
বেসরকারি কনটেইনার ডিপো বা আইসিডিতে বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণের জন্য দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতিমালা মানতে হয়। পৃথক স্থানে কনটেইনারে সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু এসবের কিছুই মানেনি বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষ।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরও জানতো না দাহ্য পদার্থ সংরক্ষণের বিষয়ে। পরিবেশ অধিদপ্তরের যথাযথ অনুমোদন ছিল না। ১২ বছরে ডিপোতে একবারও করা হয়নি অগ্নিমহড়া। ফায়ার হাইড্রেন্ট, স্মোক, হিট, মাল্টি ডিটেকটর, সেইফটি কমিটিসহ অগ্নিনির্বাপণের কোন ব্যবস্থা ছিল না ডিপোর ভেতরে।
ছিল না প্রশিক্ষণও। বছর বছর বৈদ্যুতিক সংযোগ পরীক্ষণ করা হতো না। গত বছরের ২৮ নভেম্বর কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন বোর্ডের (বিডা) উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে পরির্দশন করেছিল। এরপর সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি এসব ত্রুটির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়ে বিএম ডিপো কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছিল কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।
কিন্তু এসবের কিছুতেই কান দেয়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। ডিপোর ভেতরে স্থাপন করা হয়েছিল অনুমোদনহীন ফুয়েল স্টেশনও।
আইনের আওতায় আনা হয়নি ডিপো কর্তৃপক্ষকে
বেসরকারি ডিপোটি পরিচালনায় এতো অনিয়মের পরও মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আট জনের বিরুদ্ধে দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করেছে পুলিশ।
মামলায় ডিপোর ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আক্তার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন ম্যানেজার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ (আ্যাডমিন অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স) মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো, আইসিডি) আব্দুল আজিজ, সিএফএস ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, সিএফএস এক্সিকিউটিভ নজরুল ইসলাম খান এবং জিএম (সেলস এন্ড মার্কেটিং) নাজমুল আক্তার খানকে আসামি করা হয়। এদের মধ্যে নুরুল এই দুর্ঘটনায় একটি হাত হারিয়েছেন এবং খালেদুরের দেহের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে।
এদিকে ঘটনার ১২ দিন পার হলেও এখনো কোন আসামিকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ। সীতুকণ্ড মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "মামলার তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত শেষ হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তদন্তে যাদের অবহেলা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।"
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিল হয়নি
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়, জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ এবং ফায়ার সার্ভিস পৃথক কমিটি গঠন করেছে। তবে ঘটনার ১২ দিন পার হলেও কোন কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি । দফায় দফায় সময় বাড়াচ্ছে কমিটিগুলো।
অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত ১২ সদস্যের কমিটিকে ৫ কার্য দিবস সময় দেওয়া হয়েছিল। পরে আরো ৫ কার্য দিবস সময় বাড়ানো হয়।
তদন্ত কমিটির প্রধান মো. মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তদন্তের সুবিধার্থে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের সভাপতিকে, সিআইডির প্রতিনিধিকে এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) পোস্ট ব্লাস্ট ইভেস্টিগেশন টিম থেকে প্রতিনিধি যুক্ত করেছিলাম তদন্ত কমিটিতে। আগামী সোমবার মালিক পক্ষের সঙ্গে কথা বলা হবে। এরপর প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।"
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটিতে প্রধান করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক বদিউল আলমকে। প্রথমে সাত কর্মদিবসের সময় দেওয়া হলেও পরে আরো সাত কর্মদিবস সময় বাড়িয়ে নিয়েছে কমিটি। তদন্ত কমিটির প্রধান বদিউল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা দুর্ঘটনাস্থল, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড উৎপাদনকারী কারখানা পরির্দশন করেছি। স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।"
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক শিপন চৌধুরীকে প্রধান করে গঠিত কমিটিকে তিন কার্যদিবস সময় দেওয়া হয়েছিল। আরো ৫ কার্যদিবস সময় বাড়িয়ে নিলেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সংস্থাটি।
কমিটির প্রধান শিপন চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেক বিতরণের কারণে প্রথম দিকে আমরা কাজ করতে পারিনি। হাতপাতালে চিকিৎসাধীন শ্রমিকদেরও বক্তব্য নেওয়া হচ্ছে। প্রতিবেদন দাখিল করতে আরো সপ্তাহখানেক সময় লাগবে।"
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শফি উদ্দিনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটিকে ৫ দিনের সময় দেওয়া হয়েছিল। পরে আরো ১৫ কার্যদিবসের সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে।
তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ শফি উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা স্টেকহোল্ডারদের ডেকে কথা বলছি। তদন্তের কাজ চলছে।"
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ৫ কর্মদিবসের সময় দিয়ে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "তদন্ত কমিটি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য, ছবি, সিসিটিভি ফুটেজ, মানুষের বক্তব্য সংগ্রহ করছে। আরো দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছে কমিটি।"
ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ,পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. রেজাউল করিমকে প্রধান সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির প্রধান মো. রেজাউল করিম বলেন, "আমাদের তদন্তের কাজ এখনো শেষ হয়নি। সময় বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছি।"