পদ্মা সেতুর সুফল দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটে, ৫ ঘণ্টায় মেহেরপুরের সবজি কারওয়ানবাজারে
মেহেরপুর থেকে মরিচ ও সবজি বোঝাই করে রোববার বিকেলে (২৬ জুন) ঢাকার কারওয়ান বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দেন ট্রাক চালক লোকমান হোসেন। রাজবাড়ী হয়ে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ঘাট পেরিয়ে মাত্র ৫ ঘণ্টায় কারওরানবাজার পৌঁছান তিনি। একই রুটে এর আগে ঢাকায় পৌঁছাতে সময় লাগতো ৮/১০ ঘণ্টা।
ফেরির ভোগান্তি আর যানজট মুক্ত সড়ক স্বপ্নের মতই বলে জানালেন এই ট্রাকচালক।
পদ্মা সেতু দিয়ে সড়কপথে রাজধানীর সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের জেলাগুলো সরাসরি যুক্ত হয়েছে। তবে দক্ষিণ-পশ্চিমের ভারতীয় সীমান্তবর্তী মেহেরপুর জেলা থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে যানবাহন খুব বেশি যাওয়া আসা করবে না।
কিন্তু পদ্মা সেতুর আশির্বাদে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ও যমুনা সেতু হয়ে রাজধানীতে প্রবেশের ক্ষেত্রে এক নতুন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। এই দুই সড়কপথে এতদিন ফেরি ও যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে যাত্রীদের। মেহেরপুর থেকে সবজি নিয়ে ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই পচে নষ্ট হয়েছে অনেকের। তাই পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ অঞ্চলের কৃষকদের জন্য এক নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন সবজি চাষী ও ব্যবসায়ীরা।
রোববার ঢাকায় সবজি নিয়ে যাওয়া ট্রাক চালক লোকমান হোসেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মেহেরপুর ও গাংনী সবজি আড়ত থেকে তিনি কাঁচা মরিচ, পটল, লাউ, কুমড়াসহ বিভিন্ন সবজি বোঝাই করে বিকেলে ঢাকার পথে রওনা দেন। পথে ফেরিঘাটে গিয়ে দেখেন অবিশ্বাস্য দৃশ্য।
আগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরি পারের সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। এখন উল্টো যানবাহনের জন্য় ফাঁকা ফেরি অপেক্ষা করছে। প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর যানবাহন বোঝাই হয়ে ফেরি রওনা দেয়। ফেরি পার হয়ে মানিকগঞ্জ থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত সড়কের চিত্রও ছিল ভিন্ন। আগের মতো আর তীব্র যানজট ছিল না। ফলে মাত্র ৫ ঘণ্টায় তিনি মেহেরপুর থেকে কারওয়ান বাজারে পৌঁছেছেন।
এদিকে পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ অঞ্চলের সবজি চাষীদের মাঝেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। নির্বিঘ্নে সবজি নিয়ে ঢাকা চট্রগ্রাম যেতে পারায় বেজায় খুশি তারা। এখন কৃষকরা সরাসরি এসব বাজারে সবজি বিক্রি করতে পারবেন।
জেলার সবচেয়ে বেশি সবজি আবাদকৃত গ্রাম সাহারবাটি গ্রামের তহসিন আলী জানান, ঢাকায় সবজি বিক্রি করতে গিয়ে তারা অনেকবার বিপাকে পড়ছেন। ফেরিঘাট ও যমুনা সেতু দুই সড়কেই থাকতো তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে গিয়ে ট্রাকেই পঁচে যেতো তাদের কষ্টে উৎপাদিত সবজি। এ দুই সড়ক দিয়ে এখন নির্বিঘ্নে যাতায়াতের খবরে চাষীরা সরাসরি রাজধানীতে সবজি বিক্রি করতে পারবেন। অপরদিকে জমি থেকে বিক্রি করলেও আগের চেয়ে দর বেশি পাবেন বলে আশা করছেন তারা।
সবজি চাষী সদর উপজেলার আলমপুর গ্রামে আমজাদ হোসেন জানান, তিনি দেড় বিঘা জমিতে বাঁধাকপি আবাদ করেছেন। ব্যাপারীদের কাছে বিক্রির কথাবার্তা চলছে। পদ্মা সেতু চালুর সুযোগ গ্রহণ করতে তিনি ঢাকায় ট্রাকে করে সবজি নিয়ে যাবেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সবজি ও মরিচ ব্যাপারী কৃষ্টিয়ার মিরপুরের আবেদ আলী জানান, দীর্ঘ ১১ বছর ধরে তিনি মেহেরপুর জেলা থেকে ঢাকার সাথে কাঁচামালের ব্যবসা করছেন। সবজির পচন ঠেকাতে নির্দিষ্ট সময় ট্রাক ছাড়া হতো। এখন সেই ভয় ও দুশ্চিন্তা আর নেই। দিনের যেকোন সময় ট্রাক ছাড়লেও ঢাকায় পৌঁছাতে আর কোনো সমস্যা হবে না। মেহেরপুর থেকে যমুনা সেতু, মেহেরপুর থেকে দৌলতদিয়া ফেরি ঘাটের পাশাপাশি প্রয়োজন হলে পদ্মা সেতু দিয়েও এখন ঢাকায় প্রবেশ করা যাবে।
মেহেরপুর জেলার সবচেয়ে বড় কাঁচা মরিচের পাইকারী বাজার হচ্ছে গাংনী কাঁচা বাজার। এ বাজার থেকে প্রতিদিন রাজধানীতে ৪/৫ ট্রাক কাঁচা মরিচ পাঠানো হয়। কিছুদিন পরে মরিচ সরবাহও কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় এ বাজারের ব্যবসায়ী ও চাষীদের মাঝেও স্বস্তি বিরাজ করছে।
পদ্মা সেতুর চালুর প্রভাবের বিষয়ে জানতে চাইলে গানী কাঁচা বাজার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাহাদুল ইসলাম বলেন, "আগে মরিচ নিয়ে দুশ্চিন্তার সীমা ছিল না। সকাল থেকে মরিচ কেনা শুরু করে ট্রাক লোড করতে দিন পার হয়ে যেতো। ফলে কোন কোন সময় দুই দিন পর ঢাকায় পৌঁছাত মরিচের ট্রাক। এতে ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।"
"পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় সেই দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। এখন চাষীর সুবিধামতো সময়ে মরিচ কিনে ঢাকায় পাঠাতে আর অসুবিধা হবে না," বলেন তিনি।
ঢাকায় নিয়মিত যাতায়তকারী একটি বাসের সুপারভাইজার বলেন, "মেহেরপুর থেকে দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি পথে ঢাকার দূরত্ব অন্যান্য রুটের চেয়ে অনেক কম। ঘাটে এখন অপেক্ষা করতে হচ্ছে না। ফলে যাত্রীরা বেশ স্বস্তিতেই এ রুটে চলাফেরা শুরু করেছেন।"
এদিকে মেহেরপুর জেলা থেকে প্রতি বছরই প্রায় এক লাখ কোরবানি পশু রাজধানী ঢাকা ও চট্রগ্রামে সরবরাহ করা হয়। ফেরি পথে ভোগান্তি না থাকায় গরু খামারী ও ব্যাপারীরাও অনেক খুশি।
গরু ব্যাপারী হাফিজুল ইসলাম গত বছরের তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, "১০টি গরু নিয়ে আমি গত বছর ফেরি পারাপারের জন্য দুই দিন ফেরিঘাটে আটকে ছিলাম। দেরিতে ঢাকায় গরু নিয়ে পৌঁছানোর পর আমি কাঙ্খিত দরে গরু বিক্রি করতে পারিনি। অপরদিকে ট্রাক ভাড়াও দিতে হয়েছে দ্বিগুণ।"
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক সামসুল আলম বলেন, "সবজি, মাছ ও মাংস উৎপাদনে উদ্বৃত্ত জেলা মেহেরপুর। শুধুমাত্র সড়ক যোগাযোগের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ জেলার চাষীরা অনেক ক্ষেত্রেই নায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।"
পদ্মা সেতুর সুফল নিয়ে এ জেলার চাষীরা আগের চেয়ে এখন বেশি লাভবান হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।